অনলাইন ডেস্ক : শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে শিগগিরই রাজপথে আন্দোলন শুরু করতে পারে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ এক নেতার বরাত দিয়ে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ)। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল) ভিওএকে বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ড শুরু করার পরিকল্পনা করছি।’’
ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনার শাসনের পতনের পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন নেতার একজন শফিউল আলম চৌধুরী। লৌহমুষ্টি দিয়ে দেশ শাসন করা শেখ হাসিনা তার চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগের পর সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দলটির কয়েক ডজন নেতাকে বিক্ষোভকারীদের ওপর হিংসাত্মক দমন-পীড়নের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জুলাই থেকে আগস্টের আন্দোলনে সারাদেশে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এখন জনগণের হামলার আশঙ্কায় আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক আত্মগোপনে চলে গেছেন।
গত বুধবার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা-সহ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
টেলিফোনে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল) বলেছেন, দলটি নেতাদের একত্রিত করার জন্য কাজ করছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করার জন্য অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ করছে। আওয়ামী লীগ কবে নাগাদ রাজপথে নামার পরিকল্পনা করছে, ভয়েস অব আমেরিকার এমন এক প্রশ্নের জবাবে দলটির এই নেতা বলেন, ‘‘দুই সপ্তাহ অথবা এক মাস পর আমরা আন্দোলনে নামতে পারি।’’
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডায় বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করছে। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, গত ১৫ বছরে ব্যাপক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ। তবে রাজনৈতিক দলগুলো ইউনূস সরকারকে গণতন্ত্রে দ্রুত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য প্রকাশ্যে চাপও দিচ্ছে। অন্যদিকে, এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতিতে দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল অসন্তুষ্ট।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘‘এই সরকার কিছুটা ধীর গতিতে চলছে।’’ চলতি মাসের শুরুর দিকে ঢাকায় নিজের বাসভবনে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির এই নেতা বলেছেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেছে। কিন্তু তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি।’’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে দশটি কমিশনকে বিচার বিভাগ, পুলিশ, সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং শ্রম অধিকার-সহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ঘোষিত ছয়টি কমিশনকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রস্তাব জমা দিতে হবে। তবে সেসব প্রস্তাব পর্যালোচনা, এ জন্য রাজনৈতিক মতৈক্য চাওয়া এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রাজনৈতিক দল নির্ধারিত সময়সূচি ছাড়াই সংস্কার কাজ শুরু করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে তা দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা দীর্ঘায়িত, প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগকে হারানো রাজনৈতিক স্থান ফিরে পাওয়ার সুযোগ করে দেবে বলে উদ্বিগ্ন তিনি। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, ‘‘দেশে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সমর্থন আছে। তারা একটি অনেক বড়, পুরোনো রাজনৈতিক দল। তাই এখানে তাদের সমর্থন আছে। তারা এখানে একত্রিত হওয়ার ও সমস্যা তৈরি করার সময় পাবে।’’
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে সরকারকে একটি সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি নির্বাচন কমিশনের সদস্য বাছাই করবে। সম্প্রতি দেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিদ্যমান আইন অনুসরণ করবে। কিন্তু এই ধরনের কমিটি গঠনের তারিখ জানায়নি সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের ধীরগতির অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘‘দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন যে, আমরা রাজনৈতিক শক্তি নই এবং প্রথমবারের মতো আমরা একটি গ্রুপ হয়ে কাজ করছি।’’
গত মাসের শেষের দিকে ঢাকায় নিজের বাসভবনে ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের প্রতিশ্রুতি আছে, আমাদের পরিশ্রমী মনোভাব আছে, আমাদের সততা আছে।’’ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো, একটি সহায়ক নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে সরকারের। কারণ যা আছে তার বেশিরভাগই শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলের। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘আইন প্রয়োগকারী ও আমলাতন্ত্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করছে সরকার।’’
আওয়ামী লীগের অবশিষ্টাংশ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অন্তর্বর্তী সরকার রাজধানী ঢাকার ভেতরে ও বাইরে পুলিশ কর্মকর্তা এবং আমলাদের বদলি ও পুনর্নিয়োগ করছে। বাংলাদেশের সামনের একটি পথ নির্ধারণ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের এই আলোচনার বাইরে রয়েছে আওয়ামী লীগ।
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক সুযোগ দেওয়া উচিত। তাদের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও (একটি সুযোগ) দেওয়া উচিত। এটাতে আমি একমত।’’
তবে শিগগিরই আওয়ামী লীগকে আলোচনার টেবিলে আনা হলে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগকে সংস্কারের আলোচনায় ডাকলে, আমি মনে করি সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে।’’
আওয়ামী লীগও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বসতে আগ্রহী নয় বলে জানিয়েছেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল)। আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘‘এই (অন্তর্বর্তী) সরকার সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। আমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, সারাদেশে বিক্ষোভ দেখাই তাহলে এই (অন্তর্বর্তী) সরকার আর টিকবে না।’’
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস