ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর ওই বছরের নভেম্বর মাসে এতিমখানার শিক্ষার্থী মো. হারুন অর রশিদসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে প্রশ্ন করেন, ওই ভবনের মাত্র ১২ শতাংশ এতিমখানার নামে দিয়ে এতিমখানাকে বঞ্চিত করা হয়েছে কি না এবং এতিমখানা যে ১২ শতাংশই পাবে তার নিশ্চয়তা কী? এই প্রশ্নের পরই তাঁদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। সে সময় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন তৎকালীন লালবাগ থানার ওসিকে নিয়ে গিয়ে এতিমখানার স্টাফ ও শিক্ষার্থীদের ভয়-ভীতি দেখান। এর পরও প্রতিবাদ বন্ধ না হলে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর তিন-চারজন সাদা পোশাকধারী হারুন অর রশিদকে এতিমখানার মাঠ থেকে তুলে নিয়ে যায়।
৯ বছর ধরে চলেছে মামলা-মোকদ্দমা
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আমলে না নিলে ২০১৩ সালে এতিমখানার চার শিক্ষার্থী হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন করেন। ২০১৬ সালে আদালত কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লিমিটেডের সঙ্গে করা চুক্তিকে অসম, জালিয়াতি ও বেআইনি ঘোষণা করে তা বাতিল করে দেন। একই সঙ্গে জমিসহ পুরো ভবন এতিমখানার অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া এই চুক্তির সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসককে আদেশ দেন। ২০১৬ সালে এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। ২০১৭ সালে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের উদ্যোগে কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লিমিটেড ও এতিমখানার সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটি ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনটি আপিল করে। ২০১৮ সালের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ তিনটি আপিলই খারিজ করে দেন। এরপর বিবাদীপক্ষ আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল করে। ২০২২ সালের ৯ জুন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ওই রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন।
কাউন্সিলরের দখলে ছিল এতিমখানার দোকান
দীর্ঘ ৯ বছর ধরে সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার একটি দোকান দখল করে রাখেন এতিমখানার সাবেক ছাত্র ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক। এতিমখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, চুক্তি শেষ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ দোকানটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বললে উল্টো এতিমখানার সামনে সিটি করপোরেশনের ময়লার ভাগাড় স্থাপন করেন মানিক। পরে অবশ্য এলাকাবাসীর চাপে তা সরিয়ে নেন তিনি।
এতিমখানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ তিন বছরের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী মানিক ১২৬ বর্গফুটের একটি দোকান ভাড়া নেন। দোকানের প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারিত হয় ৫০ টাকা। সে অনুযায়ী দোকানের মাসিক ভাড়া নির্ধারিত হয় ছয় হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানিক ভাড়া পরিশোধ করেন। কিন্তু ২০১৬ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি মাসিক ভাড়া পরিশোধ করেননি। এ ছাড়া ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও তা নবায়ন না করেই দোকানটি দখলে রাখেন তিনি। কাউন্সিলর মানিকের কাছে এতিমখানার পাওনা রয়েছে ৯৭ মাসের ভাড়া বাবদ ছয় লাখ ১১ হাজার ১০০ টাকা।
জানা যায়, শুধু দোকান দখল করেই ক্ষান্ত ছিলেন না মানিক। অভিযোগ রয়েছে, ২০২২ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর এতিমখানার যে কমিটি গঠন করেছিল সেই কমিটির সদস্যদের বৈঠক করতে দিতেন না মানিক। যখনই কমিটির সদস্যরা বৈঠক করতে এতিমখানায় আসতেন তখনই মানিকের পালা সন্ত্রাসীরা তাঁদের উঠিয়ে নিয়ে যেত। এ ছাড়া এতিমখানার অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ভবনটির ভেতরের কাজ শেষ করার জন্য তিন ব্যক্তিকে ভাড়া দেয় এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। এই কাজেও বাধা দেন মানিক। তিনি জানিয়ে দেন, তাঁর কথা ছাড়া এই ভবনে কোনো কাজই করা যাবে না। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হন হাসিবুর রহমান মানিক। এর পর থেকে তিনি জেলে রয়েছেন। এ জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মানিকের সঙ্গীর দাপট
মানিকের পাশাপাশি তাঁর সঙ্গী হিসেবে পরিচিত মো. জসিম উদ্দিন প্রধান নামের একজন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই বছরের চুক্তিতে ১২১ বর্গফুটের দোকান ভাড়া নেন। প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা হিসাবে দোকানটির ভাড়া নির্ধারিত হয়েছিল ছয় হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু জসিম শুধু প্রথম মাসের ভাড়া পরিশোধ করেন। ২০১৯ সালে তাঁর দোকান ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি দোকানটি দখল করে রেখেছেন।
এতিমখানা সূত্র জানায়, জসিমের কাছ থেকে এতিমখানা ৮৭ মাসের ভাড়া বাবদ পাঁচ লাখ দুই হাজার ১৫০ টাকা পাবে। জসিম উদ্দিন প্রধান নিজের দোকান ছাড়াও ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মো. আসাদুজ্জামানের ভাড়া নেওয়া একটি দোকান এবং একই বছর মার্চ মাসে মো. জাহিদ হোসেনের ভাড়া নেওয়া একটি দোকান নিজ আয়ত্তে নিয়ে মোট তিনটি দোকান মিলিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরি করেন। কিন্তু ওই দুটি দোকানের ভাড়া জসিম পরিশোধ করেননি। দোকান দুটি থেকে ১৪৪ মাসের ভাড়া হিসেবে আট লাখ ৭২ হাজার ৩০০ টাকা পাবে এতিমখানা।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মো. জসিম উদ্দিন প্রধানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। আর মো. আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, “জসিম উদ্দিন প্রধান ২০১৮ সাল থেকে তিনটি দোকানের ভাড়া আটকে রেখেছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘তিনটি দোকান আমি চালাই। এতিমখানা আমার কাছ থেকে ভাড়া পাবে। আমি এতিমখানার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করব।’ এতিমখানার সঙ্গে আলোচনার পর এতিমখানা থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।”
এতিমখানার সম্পত্তি ছিল হাজি সেলিমের দখলে
ঢাকার আরমানিটোলার ৯ নম্বর আবুল খয়রাত রোডে স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানার নামে দোতলা বাড়িসহ ১৩ কাঠা জমি রয়েছে। বাড়িটি ২০১৫ সাল থেকে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম দখল করে রাখেন।এতিমখানা কর্তৃপক্ষের তথ্য, বাড়িটিতে পাঁচটি দোকান রয়েছে। ওই পাঁচটি দোকান ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত খালিদ জামিল আহমেদ আদিল, কালু মিয়া, ইসমত আরা লাভলী ও বাশেতুর রশিদ এতিমখানার কাছ থেকে ভাড়া নেন। এর মধ্যে খালিদ জামিল আহমেদ আদিল ও কালু মিয়া তিন বছর করে এবং বাকি দুজন দুই বছর করে দোকান ভাড়ার সময় বৃদ্ধির চুক্তি করেন। কিন্তু সেই চুক্তিও মেয়াদ শেষ হলেও তাঁরা কেউ দোকান ছাড়েননি।
এতিমখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, এই চারজনের কাছ থেকে এতিমখানা ৩৮৩ মাসের ২০ লাখ ৮২ হাজার ৩০০ টাকা ভাড়া পায়। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খালিদ জামিল আহমেদ ও কালু মিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাঁদের নম্বর দুটি বন্ধ পাওয়া যায়। এতিমখানা সূত্রে জানা যায়, মাস ছয়েক আগে কালু মিয়ার মৃত্যু হয়। তাঁর ছেলে এখন দোকানের দায়িত্বে আছেন। আর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হন ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম। এর পর থেকে তিনি জেলে রয়েছেন।
তবে সব কিছু দখলমুক্ত করে এতিমখানা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে কালের কণ্ঠকে জানান স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্ট মো. হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘কিভাবে এতিম শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার একটা স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করছি। আমাদের একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে, অন্তত এক হাজার এতিম শিশুকে যেন এখানে প্রতিপালন করতে পারি। এর পাশাপাশি আমাদের যে সম্পত্তিগুলো বেদখল করে রাখা হয়েছে, সেগুলো আমরা দ্রুত দখলমুক্ত করার চেষ্টা করছি।’
সংবাদদাতা / ইলিয়াস