অনলাইন ডেস্ক : গোলাগুলি, বোমাবাজি আর রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বারবার আলোচনায় আসছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। রাজধানীতে মাদক বিকিকিনির চিহ্নিত স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। ঘিঞ্জি বস্তির মতো এলাকাটিতে প্রতিদিন প্রকাশ্যে বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকার নানা ধরনের মাদক। ১২ বিঘা জায়গার ওপর গড়ে ওঠা জেনেভা ক্যাম্পে বসবাস ৫৫ হাজার মানুষের। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকায় মাদক কারবার করেই সংসারের চাকা সচল রাখতে হয় এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাকে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত। ক্যাম্পের জি ব্লকের সাত নম্বর সেক্টরে শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম গ্রুপের মধ্যে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। এতে ব্যবহৃত হয় আগ্নেয়াস্ত্র ও হাতবোমা। বোমার আঘাতে নিহত হন রাজ ওরফে ‘একগাল’। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পের একটি রেস্তোরাঁয় বসে ছিলেন রাজ। সে সময় একদল লোক অস্ত্রসহ ক্যাম্পে ঢোকে। তাদের মধ্যে মুখোশ পরা এক ব্যক্তি এলোপাতাড়ি বোমা ছুড়তে থাকেন। যার একটির আঘাত লাগে রাজের গায়ে। এতে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার সিলেটের কোতোয়ালি থানা এলাকা থেকে যৌথ অভিযানে বুনিয়া সোহেলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-২ ও র্যাব-৯। গতকাল শুক্রবার র্যাব-২ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক শিহাব করিম এ তথ্য জানান। বুনিয়া সোহেলের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ৩টি হত্যা মামলাসহ, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও মাদকের ১৮টি মামলা রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতের সংঘর্ষের বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বুনিয়া সোহেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার প্রতিপক্ষ চুয়া সেলিম পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করলে বুনিয়া সোহেলের লোকজন তাতে বাধা দেয়। এতেই মধ্যরাতে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় দুপক্ষই গুলি ও বোমা ছোড়ে।’
রাজের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মামলা হয়নি জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পরিবার অভিযোগ নিয়ে এলেই মামলা নেওয়া হবে। শুধু রাজ নয়, ৫ আগস্টের পর থেকে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের সংঘর্ষে আরও ছয়জনের প্রাণ গেছে। নিহত অন্যরা হলেন রাসেল, সনু, শাহনেওয়াজ ওরফে কাল্লু, সার্জন, সাগর ও শাহেনশাহ। নিহত রাজের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। গত ১৬ অক্টোবর মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হন ক্যাম্পের ৮ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ কাল্লু (৩৮)। তিনি প্রয়াত আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে। কাল্লু স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। সেদিন রাতে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে ক্যাম্পের জালাল ডেকোরেটরের সামনে দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে পড়েন। কোনো একপক্ষের গুলিতে প্রাণ যায় তার। এ হত্যার বিচার দাবি করেন তার বোন নাসরিন আখতার। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। যারা নিজেদের অবৈধ ব্যবসার জন্য আমার ভাইকে মেরেছে, তাদের কেন পুলিশ ধরে না।’
এক সময় ক্যাম্পে সংঘর্ষ হতো দা, বঁটি বা চাপাতির মতো ধারালো অস্ত্র নিয়ে। এতে অনেকেই আহত হলেও প্রাণহানি হতো না। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে সংঘর্ষ ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র ও হাতবোমা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আতঙ্কে আছেন ক্যাম্পের সাধারণ বাসিন্দারা। গতকাল ক্যাম্পের বিভিন্ন সেক্টর ও ব্লকের অন্তত দশজনের সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। আশরাফি নামে এক যুবক বলেন, আগে ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত পচ্চিশ নামে একজন। শোনা যায় সে মারা গেছে। তারপর ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন স্থানীয় কাউন্সিলর। তবে গত ৯ মাস ধরে বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমের মধ্যে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। সেটা ৫ আগস্টের পরে ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। শুধু এই গ্রুপের সংঘর্ষে গত দুই মাসে এতগুলো প্রাণ গেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে কম করে হলেও দশ বার বড় ধরনের প্রাণঘাতী সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষে ব্যবহার করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা।
স্থানীয়রা বলছেন, বুনিয়া সোহেল গ্রেপ্তার হলেও তার তিন ভাই এখনো অধরা। সোহেলের অবর্তমানে তারাই এই মাদক সাম্রাজ্য চালাবে। সেটারই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বৃহস্পতিবার রাতের সংঘর্ষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জি ব্লকের এক বাসিন্দা বলেন, ‘বুনিয়া সোহেলের তিন ভাই রানা, টুনটুন ও কালু এখনো বাইরে। তারাই ভাইয়ের সাম্রাজ্য ধরে রাখতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় চুয়া সেলিমের লোকদের সঙ্গে।’
মাদক কারবারে সক্রিয় অন্তত ১০ গ্রুপ: ক্যাম্পের অন্যতম দুই মাদক কারবারি গ্রুপ বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমের। বুনিয়া সোহেলের হয়ে কাজ করেন তার তিন ভাই ছাড়াও কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও বানর আরিফ। এছাড়া চুয়া সেলিমের পক্ষে রয়েছে আরমান, আকরাম, মোল্লা আরশাদ, পেলু, কোপ মনু, পিস্তল নাঈম, শাহজাদা গেইল হীরা, সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা ও ফাট্টা আবিদ। এর বাইরে মাদক কারবারে সক্রিয় আরমান, পলু কসাই, সৈয়দপুরিয়া, ছটু মাসুদ, মনু, চারকু ও রাজের নেতৃত্বাধীনসহ আরও কয়েকটি গ্রুপ। এদের মধ্যে সৈয়দপুরিয়া গ্রুপে আছে তিল্লি শাহিদ, কামাল বিরিয়ানি, ইরফান বিরিয়ানি, মোল্লা জাহিদ, সাজ্জাদ ও আমজাদ আলী বাবু। স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, সৈয়দপুরিয়া গ্রুপের বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু, আসলাম ওরফে মেন্টাল আসলাম ও শেখ গোলাম জিলানি মূলত পারিবারিকভাবে ইয়াবা ও হেরোইনের কারবারে জড়িত।
সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎস: স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বুনিয়া সোহেল আওয়ামী লীগের নেতাদের হয়ে আন্দোলন দমাতে সক্রিয় ছিল। পুলিশের সঙ্গে পুলিশের অস্ত্র দিয়েই আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় শীর্ষ এই মাদক কারবারি। ৫ আগস্টের আগেই বুনিয়া সোহেল পুলিশের বেশ কিছু অস্ত্র এনে রেখেছিল ক্যাম্পে। পরে সরকার পতন হলে সেগুলো আর জমা দেয়নি। সোহেল ও তার লোকজনের কাছে যেসব অস্ত্র আছে সেগুলো পুলিশের অস্ত্র।’
এছাড়া ক্যাম্পের অন্তত চারজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর ক্যাম্পের লোকজন আদাবর, মোহাম্মদপুর ও শের-ই বাংলা নগর থানায় হামলা, লুটপাট করে। সে সময় তিন থানার যত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল ক্যাম্পের দুর্বৃত্তরা নিয়ে আসে। এখন সেগুলো ব্যবহার করছে তারা। এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে ক্যাম্পে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন তারা। গত তিন মাসে জেনেভা ক্যাম্পে সংঘাতে নিহতদের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি ইফতেখার বলেন, ‘গত তিন মাসে জেনেভা ক্যাম্পে ৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আমি দুই মাস হলো থানায় যোগদান করেছি। এই দুই মাসে ৫ খুন হয়েছে।’
সংবাদদাতা / ইলিয়াস