অনলাইন ডেস্ক : গত জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের মানুষ এক রক্তক্ষয়ী কিন্তু অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়েছে। প্রবল গণরোষের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের ওপর তাঁর কায়েমি ফ্যাসিজমের কার্যত অবসান হয়েছে। তবে ৫ আগস্ট ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল দেশটা অবশেষে শান্ত হলো।
ঠিক এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বরোচিত সহিংসতার’ অভিযোগ তুলে এর নিন্দা জানিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে এক পোস্টে তিনি এ অভিযোগ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর দলবদ্ধভাবে হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
আসলে ঠিক কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বক্তব্য দিয়েছেন তা বোধগম্য নয়। তিনি আদৌ প্রকৃত কোনো তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন কি না কিংবা পেয়ে থাকলে তা যাচাই-বাছাই করেছেন কি না তা আমার জানা নেই। এর আগে একবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রিয়া সাহা নামে এক নারী তাঁর কাছে বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান উধাও হওয়ার নালিশ করেছিলেন। তবে সেবার তিনি বাংলাদেশি এ নারীর অভিযোগ খুব বেশি আমলে নেননি।
তবে এবার মার্কিন নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের এ ধরনের অভিযোগে আওয়ামী সমর্থিত লোকজন কিছুটা খুশি হয়েছে। তাঁরা ভাবছে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশ প্রশ্নে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন হতে পারে। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনার পতনের পেছনে দেশটির বর্তমান প্রশাসনের হাত রয়েছে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে শেখ হাসিনা নিজেও এ ধরনের অভিযোগ করেছিলেন। তাই আগামীতে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসুক এটা এখন আওয়ামী লীগের বিরাট চাওয়ায় পরিণত হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য আওয়ামীবিরোধীদের কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। বিশেষ করে একটি গোষ্ঠী যখন বাংলাদেশকে ‘সাম্প্রদায়িক’ দেশ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তাঁরা দেখানোর চেষ্টা করছে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে। আসলে কি তাই? আসুন, একটি সত্যানুসন্ধান করার চেষ্টা করি।
এর আগে আমরা দেখেছি কিভাবে ভারত থেকে ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার’ সম্পর্কিত ভুয়া পোস্ট ছড়ানো হয়েছে। একটা উদাহরণ দিই। ভারতের একটি সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে একটি বাড়িতে আগুন জ্বলছে এ রকম একটি ভিডিও সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে বাড়িটিতে আগুন জ্বলছিল সেটা লিটন দাসের নয়, বরং সেটা আওয়ামী লীগদলীয় এমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফির বাড়ি।
চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দিরে হামলার ঘটনা নিয়েও ভুয়া ভিডিও ছড়ানো হয়। পরে দেখা যায় হামলা মন্দিরে ঘটেনি। হামলা হয়েছিল মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত পতিত আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক কার্যালয়ে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক নিবন্ধে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল জামায়াতে ইসলামী শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল আলজাজিরা ভারতের ‘মিরর নাউ’-এর ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত দুটি খবরকে ভুয়া হিসেবে উল্লেখ করেন। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনসংক্রান্ত এ রকম অসংখ্য ভুয়া তথ্য ভারত থেকে ছড়ানো হয়। বাংলাদেশের ভেতর থেকেও হিন্দুদের ওপর আক্রমণের অপতথ্য ছড়ানো হয়।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুরা যে একেবারেই হামলার শিকার হননি তা কিন্তু নয়। তবে এখানে বিবেচ্য হলো তারা কি সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে আক্রমণের শিকার হয়েছেন, নাকি এর জন্য তাদের আওয়ামী রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাঁরা ধর্মীয়ভাবে হয়তো সংখ্যালঘু, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক। এমনকি কট্টর অনুগত হিসেবে আওয়ামী লীগের অপকর্মের সহায়ক শক্তি হিসেবে গত ১৭ বছর কাজ করেছেন।
৫ আগস্টের পর মূলত তিন দিন বাংলাদেশে কোনো প্রশাসন তেমন কার্যকর ছিল না। পুলিশ দুর্বল অবস্থায় ছিল। এ সময় দেশে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারত, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশকে স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে নেতাকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দেন।
এরপর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে আরো একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। কেউ যাতে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে আক্রমণ করে এর দায়ভার অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার ওপর চাপাতে না পারে তার নির্দেশনা দেন তারেক রহমান। নির্দেশনা পেয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে সুরক্ষা পাহারা বসান। জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতের নেতাকর্মীদের মন্দির পাহারা দেওয়ার অনন্য ঘটনাও এ দেশে ঘটে। মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন হিন্দুদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আরো একবার প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
এভাবে বাংলাদেশ যখন ধীরে ধীরে গত জুলাই-আগস্ট মাসের ক্ষত সারিয়ে ক্রমেই স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ তুললেন। এটা থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারবিরোধীরা থেমে নেই। তাঁরা বিভিন্নভাবে মার্কিন মুল্লুকে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা মার্কিন নির্বাচনকে টার্গেট করেছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করেন। এদের মধ্যে অনেকে সে দেশের ভোটার। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার আওয়ামী লীগের সমর্থক ও নেতা রয়েছেন। তাঁরা মার্কিন নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের সঙ্গে দেনদরবার করতে পারেন।
সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় কট্টরপন্থা ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা আওয়ামী লীগ ও তার অনুগতদের পুরনো অভ্যাস। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সরকারের আমলে দেশে সংখালঘুরা নির্যাতনের শিকার হন এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থার আবির্ভাব ঘটে এ রকম একটা ধুয়ো তুলে দলটি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখনো শেখ হাসিনা বিদেশে বারবারই দেশকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালান। এর সুফলও অবশ্য তিনি পেয়েছেন। একটানা ১৫ বছর স্বৈরশাসনের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। আর এ জন্য সংখ্যালঘু ও জঙ্গির ট্রাম্পকার্ড তিনি কাজে লাগিয়েছেন। দেশ ও বিদেশের মানুষকে তিনি ভুল বুঝিয়েছেন। নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন।
এবারও কিন্তু লবিস্ট নিয়োগের একটা খবর এরই মধ্যে সুইডেনভিত্তিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ওয়াশিংটনভিত্তিক লবিস্ট ফার্ম স্টার্ক গ্লোবাল ডিপ্লোমেসির সঙ্গে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে একটি চুক্তি করেছেন। এই লবিস্ট ফার্ম আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের খুবই ঘনিষ্ঠ। লবিস্টদের কাজ হবে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে মতামত প্রকাশে মার্কিন সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা। এরই প্রতিফলন হিসেবে ট্রাম্পের এমন বক্তব্য এসেছে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এ ছাড়া ট্রাম্পের এ বক্তব্যের পেছনে তাঁর নিজ দেশের রাজনীতিরও যোগসূত্র থাকতে পারে। আগামীকাল ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে রিপাবলিকান ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস। কমলা হ্যারিস একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। আর তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন পাবেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
ভারতীয় আমেরিকানরা হলো যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম অভিবাসী গ্রুপ। ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় আমেরিকানরা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে। তবে কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের এক গবেষণা বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভারতীয় আমেরিকানদের সমর্থন ৯ শতাংশ কমে ৪৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত প্রতি ১০ জনে ৬ জন ভারতীয় আমেরিকান কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে চান। আবার প্রতি তিনজনের একজন ট্রাম্পকে ভোট দিতে চান। আর ট্রাম্পকে যাঁরা ভোট দিতে চান তাঁদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া তরুণ।
হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব দিওয়ালি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ অভিযোগের পাশাপাশি এও বলেছিলেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস ও তাঁর বস জো বাইডেন সারা বিশ্ব ও আমেরিকায় হিন্দুদের অবহেলা করেছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাঁর ভালো বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের অঙ্গীকার করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রায় ২৬ লাখ হিন্দু ভোটার এ নির্বাচনে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। তাই মূল্যবান এই ভোটারদের নিজের পক্ষে টানতেই ট্রাম্প ‘সংখ্যালঘু’ ইস্যুতে বক্তব্য রেখেছেন বলে আপাতত মনে হচ্ছে।
সংবাদদাতা / ইলিয়াস