অনলাইন ডেস্ক : বরিশালগামী জাহাজে উঠলাম রাত আটটায়। ভ্রমণসঙ্গী রফিক, সৌরভ ও বশির। ভোর প্রায় ৫টায় জাহাজ ভিড়ল বরিশাল ঘাটে। আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন বরগুনার পর্যটনবান্ধব আরিফুর রহমান। প্রথমেই তিনি নিয়ে গেলেন ছাতনপাড়া রাখাইন পল্লিতে। খুবই সুন্দর পরিপাটি বাড়িঘর। পাড়াতে রয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়।
এর নাম জেয়ারামা শ্রীমঙ্গল শনি প্যাগোডা। পুরো উপাসনালয়টি চকচকে গোল্ডেন কালারে আচ্ছাদিত। উপাসনালয় দেখার পর মোটরবাইকে ছুটলাম নিদ্রা সমুদ্রসৈকতে। গিয়েই তো চোখ ছানাবড়া। এত সুন্দর সমুদ্রসৈকত নিদ্রা। অসম্ভব সুন্দর সৈকতে নগ্ন পায়ে হেঁটে বেড়াই। দূর্বা ঘাসগুলো যেন সবুজ কার্পেটের মতো বিছিয়ে রয়েছে। সৈকতের পাড়টা প্রাকৃতিকভাবেই খাঁজকাটা। ছবিতে কেউ দেখলে প্রথমেই ভেবে নেবে জায়গাটা সিতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী।
তবে ওর চেয়েও অনেক বেশি নয়নাভিরাম নৈসর্গিক। কেওড়া ও ছৈলা গাছের সারি বাড়তি সৌন্দর্যের পসরা মেলেছে। সেই পসরার ঝাঁপিতে আমরা হ্যামোক ঝুলিয়ে দোল খাই। পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর এ তিন নদীর মোহনায় নিদ্রা সমুদ্রসৈকত। এরপর ছুটলাম ফকিরের হাট। যেতে যেতে আবহমান বাংলার রূপ দেখি। হাত বাড়ালেই গাছে গাছে ঝুলে থাকা টসটসে পাকা খেজুর। তাল বৃক্ষের সমারোহ। সারিসারি জেলে নৌকার বহর। এক কথায় অসাধরণ এক গ্রামীণ পরিবেশ। ফকিরের হাট বাজারে দুপুরের আহার সেরে ছুটলাম এবার শুভসন্ধ্যা সৈকতের পথে।
ডিসি পয়েন্ট পৌঁছে ছোট্ট একটা খাল পার হয়ে শুভসন্ধ্যা সৈকতে গিয়ে উঠি। ঝাউগাছ আর ঝাউ গাছ। বালুকাময় সৈকত। একপাশে বিশাল জলরাশি, আরেক পাশে সতেজ সবুজ ঝাউবন। বিশেষ করে কক্স, সেন্টমার্টিন সৈকতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সাগর লতা এখানে প্রচুর। এ রকম মনোরম দৃশ্য দেহমনে বেশ প্রশান্তি এনে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে ঝাউবন ছাড়িয়ে অদ্ভুদ আকৃতির গাছপালা ঘেরা এক জঙ্গলের দেখা পাই। সৈকত ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। যতই এগিয়ে যাই ততই যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ ঘিরে ধরে। সত্যিই রোমাঞ্চকর অনুভূতি। স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায় এ জঙ্গলটার কেতাবি কোনো নাম নেই।এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বন্য গাছ।
এর মধ্যে শৈলা, কেওড়া, জিলাপি, বাইন, সুন্দরী ও শিশু গাছ। গাছগুলোর ডালপালা এতটাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যে, দিনের আলো সেখানে প্রায় মলিন।শুভসন্ধ্যা সৈকত প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে প্রায় দুই কিলো হেঁটে নিদ্রার পথ ধরি। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার পর, রাতে সেখানেই তাঁবু গাড়ব। নিদ্রাসৈকতে পৌঁছেই মনোমুগ্ধকর এক সূর্যাস্তর সাক্ষী হলাম। মাছ ধরার ট্রলারে চেপে সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ ফেরার সময়কালে সূর্য ডোবার যে রকম দৃশ্য চোখে পড়ে, ঠিক ওরকমটাই নান্দনিক লাগবে নিদ্রাসৈকত থেকে।
আলো থাকতে থাকতেই এবার তাঁবু টানাতে সবাই ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত বারবিকিউ করার জন্য দেশি মোরগের খোঁজে। বাঁকা চাঁদ উকি দিতেই ক্যাম্পফায়ার সঙ্গে স্থানীয় ভোকাল সগিরের গানের তালেতালে আমাদের নৃত্য। গাছের ডালে ডাইরেক্ট মুরগি ঢুকিয়ে চলে বারবিকিউ। লেলিহান আগুনে ক্ষণিকের মধ্যেই ঝলসানো মোরগ সবার পেটে। তাঁবুর ভেতর থেকে আসমানে থাকা লক্ষকোটি তারার মেলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুম থেকে উঠে সমুদ্র পাড়ে খুব সুন্দর একটা ভোরের আলো উপভোগ করে ছুট দিই হরিণঘাটার পথে। নিদ্রাবাজার থেকে ট্রলারে চেপে বসি। এরপর প্রায় দুঘণ্টা ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছি পাথরঘাটা।
আমাদের আসার সংবাদ পেয়ে আগেই নদীর ঘাটে অপেক্ষায় ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু জাফর। আমাকে দেখে ওই যারপরনাই বেশ আনন্দিত। আমিও আপ্লুত। দেরি না করে অটোতে উঠে পড়ি। যেতে যেতে হরিণঘাটা ইকো পার্কের গেটে। প্রবেশ ফি পরিশোধের মাধ্যমে ঢুকে পড়ি। সুন্দরী, কেওড়া, পশুর ও গেওয়া গাছের প্রাকৃতিক বন। এটা সুন্দরবনেরই একটা অংশ। পর্যটকদের জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার ও দৃষ্টিনন্দন ফুট ব্রিজ। এ বনে তেমন হিংস্র প্রাণী নেই। তবে প্রচুর হরিণ ও প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির বন্য প্রাণীর বিচরণ রয়েছে। সুন্দরবনের মতোই প্রচুর গোল গাছ ও শ্বাসমূল উদ্ভিদ সমৃদ্ধ এই বন।
বনের ভেতরই সমুদ্রসৈকত লালদিয়া যাওয়ার জন্য বোটে চড়ে বসি। খাল দিয়ে যখন বোট ছুটল তখন মনে হলো, আমরা যেন হরিণঘাটা নয় মূল সুন্দরবনের কোনো খালের ভেতর দিয়েই যাচ্ছি। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বোট থেকে নেমে আবিষ্কার করি অন্যরকম এক জগৎ। হ্যাঁ এ জগতের সৌন্দর্য শুধু ভ্রমণপিপাসুরাই উপলোব্ধি করতে জানে। দেরি না করে দ্রুত নেমে যাই আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি গড়তে। পেটে টান পড়তেই পরতে পরতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধারণ করা ‘ও ভাইয়ু’ ‘ও ভাইয়ু’ বলে সম্বোধন করা নাগরিকদের জেলা বরগুনা ভ্রমণের ইতি টানি।
যাবেন কীভাবে : ঢাকা-কুয়াকাটার বাসে চড়ে আমতলী। সেখান থেকে অটো/মোটরবাইকে তালতলীর নিদ্রাসৈকত। দেখতে দেখতে যেতে চাইলে ঢাকার সদরঘাট থেকে জাহাজে চড়ে বরিশাল/পটুয়াখালী/আমতলী পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কোথায় খাবেন এবং থাকবেন : ধারেকাছে হোটেল মোটেল নেই। স্থানীয় কারও কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁবু গেড়ে থাকা যাবে।আশপাশে থাকা জেলে পরিবারদের সঙ্গে আলাপ করে, খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।
নিউজ২৪/ সংবাদদাতা/ ইলিয়াস