অনলাইন ডেস্ক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালসহ তাঁর ১৪ জন স্বজনের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে আট বছরে জমা হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। স্বজনদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর মা, ভাই, বোন ও ভগ্নিপতি। আরও আছেন ফয়সালের স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও শ্যালক।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ওই টাকা জমা (সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসহ) হয়েছিল। এর বাইরে ফয়সাল, তাঁর মা, বোন, স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও ভগ্নিপতি আবদুল্লাহর নামে ২১ কোটি টাকা মূল্যের (দলিল মূল্য) ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি কেনা হয়। যদিও তাঁদের কেউ বড় কোনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন। এমনকি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ কোনো পদেও তাঁরা চাকরি করেন না।
ফয়সালের মা, বোন, স্ত্রী, শাশুড়ি, খালাশাশুড়ি গৃহিণী। স্বজনদের মধ্যে শুধু ফয়সালের ভগ্নিপতি সৈয়দ আবদুল্লাহ পুলিশের পরিদর্শক। তিনি এখন ফেনী জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত। এর আগে তিনি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন। আর ফয়সালের ভাই পেশায় আইনজীবী।
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে মূলত তাঁর ভগ্নিপতি আবদুল্লাহর সম্পদের খোঁজ করতে গিয়ে। আবদুল্লাহ যখন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার ওসির দায়িত্বে ছিলেন, তখন তাঁর অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। এরপর দুদকের পিরোজপুরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের তিনজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে অনুসন্ধান কমিটি (গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে) গঠন করা হয়।
সৈয়দ আবদুল্লাহ ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত মঠবাড়িয়া থানার ওসির দায়িত্বে ছিলেন। ফয়সালের মা, বোন, স্ত্রী, শাশুড়ি, খালাশাশুড়ি গৃহিণী। স্বজনদের মধ্যে শুধু ফয়সালের ভগ্নিপতি সৈয়দ আবদুল্লাহ পুলিশের পরিদর্শক। তিনি এখন ফেনী জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত।
দুদকের ওই কর্মকর্তা বলেন, সেই কমিটির অনুসন্ধানে আবদুল্লাহর বিপুল সম্পদ থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর গত বছরের মে মাসে আবদুল্লাহর স্ত্রী ফারহানা আক্তারের (ফয়সালের বোন) নামে ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট ও একটি কমার্শিয়াল স্পেস (বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য), শাশুড়ি কারিমা খাতুনের (ফয়সালের মা) নামে গুলশানে একটি ফ্ল্যাট থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয় দুদক। এর বাইরে ফয়সালের বোনের ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এরপর ফয়সালের বোন, মা, ভগ্নিপতির নামে থাকা সম্পদ ক্রোক (জব্দ) করতে আদালতে আবেদন করে দুদক। এর ভিত্তিতে আদালত গত বছরের ২৮ মে তাঁদের নামে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ দেন। এই সম্পত্তির মূল্য ১৮ কোটি টাকা।
মা, বোন ও ভগ্নিপতি—এই তিনজনের সম্পত্তি জব্দ হওয়ার ১১ মাস পর ফয়সালসহ আরও ১১ জনের সম্পত্তির তালিকা আদালতের কাছে তুলে ধরে দুদক। এর ভিত্তিতে গত ২৭ জুন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন ফয়সালের সম্পত্তি জব্দের আদেশ দেন। আদালত যখন এই আদেশ দেন, তখন ফয়সাল ছিলেন এনবিআরের ঢাকা কার্যালয়ের প্রথম সচিব (কর)। পরে তাঁকে এনবিআর থেকে ‘অবমুক্ত’ করে বগুড়া কর অঞ্চলের পরিদর্শী রেঞ্জ-১-এ বদলি করা হয়।
গত বছরের মে মাসে আবদুল্লাহর স্ত্রী ফারহানা আক্তারের (ফয়সালের বোন) নামে ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট ও একটি কমার্শিয়াল স্পেস (বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য), শাশুড়ি কারিমা খাতুনের (ফয়সালের মা) নামে গুলশানে একটি ফ্ল্যাট থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয় দুদক। এর বাইরে ফয়সালের বোনের ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বক্তব্য জানতে গত সাত দিনে কয়েক দফায় মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে ফয়সালের বিষয়ে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। আরও বলেছে, আয়কর কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে বদলি এবং আয়করদাতাদের ভয় দেখিয়ে অর্থ নেওয়াসহ দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ফয়সালের ভগ্নিপতি সৈয়দ আবদুল্লাহর বিষয়েও আদালতে দেওয়া পৃথক প্রতিবেদনে একই ধরনের কথা বলেছে দুদক। আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, মাদক ও চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্যসহ দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হন। বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ আবদুল্লাহর বক্তব্য জানতে একাধিকবার মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে । এর মধ্যে একবার তিনি ফোন ধরে এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ‘এখন কথা বলতে পারবেন না’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ফয়সালের মা-বোনের নামে যত সম্পদ
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল্লাহর সম্পদের সিংহভাগ রয়েছে স্ত্রী ফারহানা (ফয়সালের বোন) ও শাশুড়ি কারিমার (ফয়সালের মা) নামে। ফারহানা ও কারিমা দুজনই গৃহিণী। সম্পদ জব্দের বিষয়ে আদালতের আদেশ অনুযায়ী, ফারহানার নামে ১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর নামে ৯টি ব্যাংক হিসাব আছে। এর মধ্যে ৬টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয় ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। ২০২১ সালে খোলা একটি হিসাবে জমা রাখা হয় ১ কোটি টাকা।
তাঁর ৯টি ব্যাংক হিসাবে মোট ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা জমা হয়েছিল। এর বাইরে ফারহানার নামে কাকরাইলের একটি বাণিজ্যিক ভবনে ২৩৮৬ বর্গফুট কমার্শিয়াল স্পেস রয়েছে। যার দাম ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ছাড়া মগবাজারে তাঁর নামে ২ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ও খিলগাঁওয়ে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট রয়েছে। আর গুলশানে ফয়সালের মা কারিমা খাতুনের নামে ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট রয়েছে।
ফয়সালসহ ১১ জনের যত সম্পদ
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফয়সাল তাঁর সম্পদ করেছেন স্ত্রী আফছানা নাজনীন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে। নিজের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্লট ও জমি কিনেছেন ফয়সাল। এ ছাড়া তাঁর নামে ছয়টি ব্যাংক হিসাব আছে। এসব হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জমা হয়েছিল ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। দুদক আদালতে দেওয়া আবেদনে বলেছে, ফয়সালের স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর বাইরে তাঁর নামে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে খোলা হিসাবগুলোয় জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর বাইরে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তাঁর নামে ঢাকা ও রূপগঞ্জে মোট ১০ কাঠার প্লট কেনা হয়।
অন্যদিকে ফয়সালের শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ২০২২ সালে ঢাকায় ১০ কাঠার প্লট কেনা হয়। দলিলমূল্যে এর দাম ৫২ লাখ টাকা দেখানো হলেও দুদক এ বিষয়ে আদালতকে জানিয়েছে, ওই প্লটের দাম সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তাঁর নামে খোলা আটটি ব্যাংক হিসাবে ৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা) নামে গত বছর এক কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনা হয়। এ ছাড়া তাঁর নামে ২০২০ ও ২০২১ সালে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এ ছাড়া তাঁর নামে থাকা আটটি ব্যাংক হিসাবে ১১ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য পেয়েছে দুদক। ফয়সালের শ্যালক আফতাব আলীর নামে ২০২০ ও ২০২১ সালে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এ ছাড়া তাঁর নামে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। এতে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফয়সালের ভাই কাজী খালিদ হাসানের (আইনজীবী) নামে ২০২১ সালে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এ ছাড়া ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তাঁর ছয়টি ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ১২ লাখ টাকার অর্থ জমা হয়। ২০২১ ও ২০২২ সালের মধ্যে ফয়সালের মামাশ্বশুর শেখ নাসির উদ্দিনের দুটি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অন্যদিকে ফয়সালের খালাশাশুড়ি মাহমুদা হাসানের নামে ২০২১ সালের একটি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৩ কোটি ৭৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া খালাশাশুড়ি মাহমুদার মেয়ে ফারহানা আফরোজের চারটি ব্যাংক হিসাবে (২০২০-২৩ সালের মধ্যে খোলা) ১ কোটি ২১ হাজার টাকা জমা হয়।
আদালতে দেওয়া দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ফয়সালের পূর্বপরিচিত খন্দকার হাফিজুর রহমানের (মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী) নামে ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এর বাইরে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তাঁর নামে খোলা পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
খন্দকার হাফিজুরের বাড়ি খুলনা শহরের বয়রা এলাকায়। গত ২৫ জুন বয়রা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাফিজুরের বাড়ি একতলা। তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বেগম বলেন, তাঁর স্বামী মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী। টাকাপয়সা তেমন না থাকায় বাড়ি সংস্কার করতে পারছেন না। বৃষ্টি হলে ঘরে পানি ঢোকে। ফয়সালদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের সঙ্গে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তবে ফয়সালের বাবার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বন্ধুত্ব আছে। আদালতে দেওয়া দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফয়সালের এক স্বজন রওশন আরা খাতুনের নামে থাকা দুটি ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা জমা হয়। এই দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয় ২০১৯ ও ২০২০ সালে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে কারও পক্ষে বৈধভাবে এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির কারণে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন। সরকারের উচিত সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া। যাঁদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকবে, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস