ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী জানান, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেল ৪টায় ত্বকী চাষাঢ়ায় সুধীজন পাঠাগারে যাচ্ছিল। পথে তাকে অপহরণ করে পাঠাগারের উল্টোদিকে সায়াম প্লাজায় শামীম ওসমান ঘনিষ্ঠ শাহ নিজামের অফিসে নেওয়া হয়। সেখানে প্রথমে ত্বকীর ওপর নির্যাতন চালানোর পর রাত ৯টায় নেওয়া হয় আল্লামা ইকবাল সড়কে শামীম ওসমানের প্রয়াত বড় ভাই নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে।
নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক, সংক্ষেপে নম পার্ক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা স্টেডিয়ামের কাছে অবস্থিত এই পার্ক কয়েক বছর ধরে আলোচনায়। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বী বলেন, এই নম পার্ক ছিল কাশিমবাজার কুঠি। এখানে বসেই শামীম ওসমানের লোকজন নানা অপকর্ম করত। বিগত দিনে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের ডেকে এনে এখানে শাসানো হতো। গত ৫ আগস্ট এই পার্কটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানায়, ফতুল্লা ও কুতুবপুর এলাকার কোনো জমি বিক্রি করতে হলে আসতে হতো এই পার্কে। এখানে বসেই শাহ নিজাম সাধারণ ক্রেতা ও জমির মালিকদের নাজেহাল করতেন।
নারায়ণগঞ্জ ক্লাব এলিট শ্রেণির ক্লাব হিসেবে পরিচিত। এই ক্লাবের ৩০৪ নম্বর কক্ষটি শামীম ওসমানের নামে বরাদ্দ ছিল। শামীম ওসমান শহরের অপছন্দের ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে এখানে সায়েস্তা করতেন। সাবেক জাতীয় ফুটবলার সম্রাট হোসেন এমিলি একবার অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, এ ক্লাবে তাঁকে ডেকে নিয়ে শামীম ওসমান অস্ত্র ঠেকিয়েছিলেন। গত ৪ আগস্ট ক্লাবটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় আর ৫ ও ৬ আগস্ট ক্লাবটি লুট করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
চাষাঢ়ায় অয়ন ওসমানের অফিস
শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের অফিস ছিল চাষাঢ়ায় ডাকবাংলোর পাশে একটি বহুতল ভবনে। মূলত ওই অফিসটি ব্যবহার করা হতো টর্চার সেল হিসেবে। ৫ আগস্টের পর অয়ন ওসমান পালিয়ে গেলে ওই অফিসটিতে তালা মেরে দেওয়া হয়।
চাষাঢ়া রাইফেল ক্লাব
চাষাঢ়ায় নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবটিকে অঘোষিত কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন শামীম ওসমান। ইসলামী আন্দোলনের নেতা হাফেজ জাকির হোসেন জানান, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়াতে তাঁকে এই ক্লাবে ডেকে এনে চাপ দেওয়া হয়।
তোলারাম কলেজ
সরকারি তোলারাম কলেজের ছাত্রসংসদ ছিল প্রকাশ্য এক টর্চার সেল। সাংবাদিক, সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রদলের কর্মী কেউই বাদ যায়নি এই টর্চার সেলের নির্যাতন থেকে। ২০২২ সালের ১৫ জুলাই রাতে এই কলেজের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাত্রদলের চার নেতাকর্মীকে পেটান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার নেতৃত্ব দেন অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠ কলেজের ভিপি হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গেলে ছবি ও ভিডিও ধারণে বাধা দিয়ে দুই সাংবাদিককে মারধর করা হয়। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরকারি তোলারাম কলেজে ফরম পূরণ করতে গিয়ে রিয়াদ ও তাঁর লোকজনের মারধরের শিকার হন ওই কলেজের দুই শিক্ষার্থী আতা-ই-রাব্বী ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। মূলত কলেজের ছাত্রসংসদের কক্ষে বসে এসব ঘটনা ঘটানো হতো। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তোলারাম কলেজের ভেতর দখল করে রাখা ছাত্রসংসদের কক্ষ গুঁড়িয়ে দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
মানবাধিকারকর্মী ও নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ওসমান পরিবার জিম্মি করে রেখেছিল। গত ১৫ বছর নারায়ণগঞ্জের কোনো মানুষ ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না। আমরা চাই বর্তমান প্রশাসন শক্ত হাতে নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করবে। নারায়ণগঞ্জ শান্তির শহর হোক—এটাই আমাদের কাম্য।’
ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, ‘ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের মানুষকে সব সময় লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। কারণ সব সময় পুরো নারায়ণগঞ্জকে গডফাদারের নারায়ণগঞ্জ বানিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত ছিল তাদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের প্রকৃত চেহারা সাধারণ মানুষ দেখতে পেয়েছে। তারা শুধু ওই আন্দোলনের ওপর হামলা চালিয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। নারায়ণগঞ্জের মানুষ ত্বকী, বুলু, চঞ্চল, আশিক হত্যাসহ বহু হত্যাকাণ্ড দেখেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবার জড়িত। তোলারাম কলেজের ছাত্রসংসদকে রীতিমতো তারা টর্চার সেলে পরিণত করেছিল। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি।’
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস