বুকে কষ্ট চেপে রেখে রোকেয়া বেগম বলেন, ‘৪ আগস্ট আন্দোলনে আমার স্বামীর গায়ে গুলি লাগে। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে আমার স্বামীর অপারেশন হয়। অপারেশনের পর আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এর মধ্যে আমার বাচ্চা হয়। সেই সময় হাতে টাকা ছিল না। স্বামীর চিকিৎসা করাতে হবে, তাই তিন দিনের বাচ্চাকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিই। সেই টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করছি। খারাপ তো লাগবে। কিন্তু সেই সময় কোনো উপায় ছিল না। স্বামীকে তো বাঁচাতে হবে।’
তিনি বলতে চেষ্টা করেন, ‘পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তার স্বামী। তার একটা অপারেশন হয়েছে। আরো অপারেশন লাগবে। সুস্থ হতে তার আরো এক-দুই বছর সময় লাগতে পারে। আর পুরো সুস্থ না হওয়ারও ঝুঁকি আছে। তিনি সুস্থ না হয়ে উঠলে যে সন্তান এখন কাছে রয়েছে তাকে নিয়েই পথে বসতে হবে। সে কারণেই ছোট্ট সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বরং সে এখন যাদের পরিবারে গেছে, সেখানেই ভালো থাকবে। আমরাও হয়তো ভালো থাকব!।’
গুলিবিদ্ধ আহত আবদুর রশিদ বলেন, ‘দিনমজুর মানুষ, অপারেশনে অনেক টাকার প্রয়োজন হওয়ায় স্ত্রী একজনের কাছে শিশুসন্তানকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। এক সস্তানের জন্য কষ্ট হলেও আরেক সন্তান ও স্ত্রীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তা মেনে নিয়েছি।’ রশিদের প্রতিবেশীরা জানায়, রশিদ-রোকেয়া দম্পতির নিজের কোনো জায়গাজমি নেই। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকেন তারা। স্থানীয়রা জানায়, ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে রশিদকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। ওয়ার্ড জামায়াতের আমির আবদুর রহিম জানান, ভবিষ্যতেও তারা রশিদের পাশে থাকবেন।
দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এ টি এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ১৮২ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের অপারেশন করা হয়েছে এবং কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একসঙ্গে একই ধরনের অনেক রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেক ধরনের ওষুধ ও সরঞ্জাম হাসপাতালে সরবরাহ ছিল না। সেগুলো অনেক রোগীকেই বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা নিয়ে যাওয়াদের মধ্যে এখনো যাদের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে, তাদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
দিনাজপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবির হোসেন বলেন, ‘আমরা রশিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিক্রি করা শিশুটিকে তারা ফিরিয়ে এনে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রশিদ-রোকেয়ার আর্থিক অবস্থা এখন এতটাই করুণ যে, একটা বাড়তি মুখে ঠিকঠাক খাবার তুলে দেওয়া বা যত্ন নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই হয়তো সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’ দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান বলেন, ‘আন্দোলনে আহতদের মধ্যে যাদের তথ্য আমাদের কাছে কাছে, আমরা তাদের নানাভাবে সহায়তার চেষ্টা করছি। আমরা রশিদ ও তার পরিবারের পাশে থাকব। যত দ্রুত সম্ভব তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলব।’
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস