অনলাইন ডেস্ক : আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়া দুর্নীতির রাজকুমার পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বিভিন্ন দেশ ঘুরে এখন থিতু হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, পর্তুগাল—কোথাও যেন শান্তি নেই! তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখনকার মতো অস্ট্রেলিয়ায়ই আবাস গেড়েছেন। রূপকথাকেও হার মানিয়ে দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একসময়ের অত্যন্ত পরাক্রমশালী এই পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর। প্রচার আছে, পোশাকি সৎ মানুষের আড়ালে তিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘুষের রেট বদলাতেন।
৪৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ : দুদকের অনুসন্ধান টিম গত জুলাই মাসের শুরুতে কমিশনে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সেখানে বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে মোট ৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫২ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীর আহমেদের নামে মোট ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৫ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে মোট ২১ কেটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাঁদের বড় মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে মোট আট কোটি ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৬ টাকা মূল্যের এবং মেজো মেয়ে তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে চার কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। আদালতের আদেশে এসব সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
গুলশানে চার ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ : বেনজীর আহমেদের পরিবারের মালিকানায় থাকা রাজধানীর গুলশানের অভিজাত চারটি ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ রয়েছে। ওই সব ফ্ল্যাট সম্পর্কে তেমন কথা বলছেন না ভবনের দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা। তবে ওই ভবন এবং আশপাশের বাসিন্দা সবাই অবগত আছে যে ওই ভবনে বেনজীরের চারটি ফ্ল্যাট আছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গেলে নিরাপত্তাকর্মীরা এমন তথ্যই জানিয়েছেন। গুলশান-১-এর ১২৬ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ি র্যাংকন আইকন টাওয়ারে অবস্থিত এই চারটি ফ্ল্যাট। এর দুটি দুই হাজার ২৪২ বর্গফুটের এবং বাকি দুটি দুই হাজার ৩৫৩ বর্গফুট আয়তনের।
ভবনের নিরাপত্তাকর্মী শাকিবের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ওই সব ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না। তালাবদ্ধ রয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা মাস দুয়েক আগে এসে পরিদর্শন করে গেছেন। গোপালগঞ্জের সাভানা পার্ক : বেনজীর আহমেদের আলোচিত সেই সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক সরকারি ব্যবস্থাপনায় রিসিভার কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। রিসোর্টের সব আয় তদারকি কমিটির ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়। স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সেখান থেকেই ব্যয় করা হয়ে থাকে।
রিসিভার কমিটির সদস্যসচিব ও গোপালগঞ্জ দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক, ডেইরি ফার্মসহ যেসব সম্পদ বা স্থাপনা গোপালগঞ্জে রয়েছে তার পরিধি অনেক। এসব স্থাপনা দেখভাল করার জন্য বেশ লোকবল প্রয়োজন। সেই তুলনায় আয় কম। তাই মাস শেষে বেতন-ভাতা দিতে আমাদের বেগ পেতে হয়। এই কারণে গেল আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বেনজীর আহমেদের গোপালগঞ্জে যে সম্পদ সেসব সম্পদ ইজারার মাধ্যমে পরিচালনার জন্য একটি আবেদন করা হয়েছে।’
আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সাভানা পার্কে গত ৭ জুন রাতে রিসিভার নিয়োগ করে পার্কটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সার্বিক তদারকির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক এবং গোপালগঞ্জ দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালককে সদস্যসচিব করে ছয় সদস্যের একটি তদারকি কমিটি গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
মাদারীপুরে বিপুল ফসলি জমি : বেনজীর আহমেদ মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন মৌজার কোটি কোটি টাকার ফসলি সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। তাঁর লোক দিয়ে কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, আবার কারো কারো ফসলি জমি কিনেছেন কৌশলে। দুদকের আবেদনে এসব সম্পত্তির ওপর আদালতের নির্দেশ এখনো বলবৎ রয়েছে। দ্রুত আইনি কাজ শেষ হলে কৃষকরা সম্পত্তি ফিরে পেতে চান।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে কেনা উল্লিখিত দলিলগুলোতে জমির পরিমাণ প্রায় ২৭৩ বিঘা। এসব জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। যদিও বাস্তবে এসব জমির ক্রয়মূল্য দলিলে দেখানো মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১১৩টি দলিল হয়েছে।
রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের আড়ুয়াকান্দি গ্রামের ভাষারাম সেন বলেন, ‘২৪ একর ৮৩ শতাংশ ফসলি জমি আমাদের বংশীয় লোকদের। এই জমি সবটুকুই কিনে নেন সাবেক পুলিশপ্রধান। বিঘাপ্রতি সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছেন। প্রায় দুই বছর আগে ভয়ভীতি দেখিয়ে এই জমি নেন বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। প্রথমে চারদিক থেকে জমি কিনে নেন তিনি, মধ্যখানে আমাদের জমি থাকায় সেটা লিখে দিতে বাধ্য করেন।’
রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক বলেন, ‘এসব সম্পত্তির বিষয়টি উচ্চ আদালতের নির্দেশে এখনো একই অবস্থায় রয়েছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি।’ রূপগঞ্জের ডুপ্লেক্স বাড়ি : রূপগঞ্জের দক্ষিণবাগ মৌজার চোরাব গ্রামে আনন্দ হাউজিংয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ডুপ্লেক্স বাড়িটি এখন জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। ২৪ কাঠা জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি দেখভাল করে নিরাপত্তা প্রহরী ও গ্রাম পুলিশ। এদিকে পূর্বাচল উপশহরের ১৭ নম্বর সেক্টরে ছিল ১০ কাঠার প্লট। এই প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রায় এক বছর আগে এই প্লট বিক্রি করে দেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আনন্দ হাউজিংয়ের বাড়িটি এখন সুনসান। একজন নিরাপত্তা প্রহরী ও গ্রাম পুলিশ বাড়িটি দেখভাল করছে। মাঝেমধ্যে বাড়িটি দেখতে লোকজন ভিড় করে। বান্দরবানে ২৫ একর পাহাড়ি জমি : বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা বান্দরবানে শুধু ২৫ একর পাহাড়ই হাতিয়ে নেননি, রাবার চাষের জন্য ২৫ বছর মেয়াদি পাহাড় লিজ নিয়ে রাবারবাগান সৃজন তো দূরের কথা, উল্টো এই জমির অনুকূলে প্রায় ১৫ হাজার ঘনফুট কাঠের ভুয়া ফ্রি পারমিট আদায় করে দুই কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন।
বেনজীর আহমেদ তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা এবং কন্যা ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক মৌজায় অন্যের নামে লিজ দেওয়া ৭২০ নম্বর হোল্ডিংভুক্ত ২৫ একর পাহাড় নিজ নামে করিয়ে নেন। নাম পরিবর্তন করার সময় তিনি নিজের পরিচয় এবং নিজ জেলার তথ্য গোপন করে বান্দরবান সদর উপজেলার ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজার বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করেন।
তবে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আদালতের নির্দেশে গত ৪ জুলাই বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন নিজে উপস্থিত হয়ে ওই প্লট এবং এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সরকারের জিম্মায় নিয়ে ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফটক এখনো তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। বিলাসবহুল রেস্টহাউস এবং অন্যান্য স্থাপনা খালি অবস্থায় পড়ে আছে।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস