বাংলাদেশের শিক্ষকতা পেশাকে যদি উক্ত আন্তর্জাতিক সূচক দুটির বিবেচনায় পর্যালোচনা করি, তাহলে প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠবে। বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশার নানা ধরনের মধ্যে বিসিএস সাধারণ শিক্ষাকে পেশাগত দিক থেকে অনেকটাই অগ্রগামী বলে মনে করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসা নানা বৈষম্য ও হতাশা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের নিশ্বাস চেপে ধরেছে। যেমন- ১) বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সিডিউলভুক্ত বেশ কিছু পদ থেকে শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের কৌশলে বিতাড়িত করা হয়েছে; ২) পদসোপানে অন্যান্য অনেক ক্যাডারের প্রথম গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারের সকল অধ্যাপকগণকে ৪র্থ গ্রেডে থেকেই চাকুরী থেকে অবসরে যেতে হচ্ছে; ৩) ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনসহ বেশ কয়েটি শিক্ষা কমিশনের সুস্পষ্ট মতামত থাকার পরও শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চতর পদে এবং শিক্ষার নীতিনির্ধাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে; ৪) ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে শিক্ষকদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান সুস্পষ্ট না থাকায় অন্য ক্যাডারের ১০ থেকে ১৫ ব্যাচ জুনিয়র সদস্যও শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যকে ভাই বা পদবি ধরে সম্বোধন করেন; ৫) শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি একটি নিয়মিত অফিস ওয়ার্ক সত্ত্বেও পদোন্নতির জন্য শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিতে হয়; ৬) শিক্ষা ক্যাডারের পদসোপানে ৯ম থেকে ৪র্থ গ্রেড পর্যন্ত মাত্র ৪টি ধাপ থাকায় চরম বৈষম্য বিদ্যমান, পদ সৃষ্টির সুযোগ সংকোচিত এবং ছাত্র-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত ব্যাহত। অথচ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিটি নীতিমালা ও কৌশলপত্রে ছাত্র-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত মাধ্যমিক পর্যায়ে ১:৩০ ধরা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২০২৪ সাল নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত ১:২০ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো- ছাত্র-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত নিশ্চিত করার জন্য কি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হ্রাস করা হবে? যদি তা না হয়, তাহলে এই আদর্শ অনুপাত বজায় রাখতে অবশ্যই পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। কাজেই শিক্ষকদের জন্য নতুন পদসোপান অনুমোদন এবং সেই অনুযায়ী পদ সৃষ্টি করে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে; নতুবা পরিকল্পনা শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশে পদ্ধতিগত কারণে সরকারি কলেজসমূহে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ বজায় থাকলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ, এমনকি প্রাথমিক থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে যথেষ্ট উদাসীনতা লক্ষণীয়। উন্নত বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগে যেখানে মেধাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়। শুধু শিক্ষক নিয়োগেই অবহেলা শেষ কথা নয়; অতিরিক্ত সহজ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নকে হালকাভাবে গ্রহণের নীতিমালা শিক্ষা বোর্ডগুলোর এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতা, যা শিক্ষার গুণগত মানকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান ছাড়াও শিক্ষকদের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়; যেমন- গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভূমিকা রাখা। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে যারা মাঠে থেকে ভোটগ্রহণ করেন, নির্বাচনের ফলাফল প্রস্তুত করেন, কেন্দ্র পর্যায়ে ফলাফল ঘোষণা করেন তাদের সিংহ ভাগই এ দেশের শিক্ষক সমাজের সদস্য। অথচ মাঠপর্যায়ে নির্বাচনী কাজে দায়িত্বশীল এইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বারবার। কাজেই দেখা যাচ্ছে যিনি দায়িত্ব নেবেন তাকেই ক্ষমতায়ন করতে হয়।
আমাদের সংবিধান, শিক্ষানীতি, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন, নীতিমালা ও কৌশলপত্র নিয়ে যখন অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সাথে কথা হয় তখন তারা বলে, তোমাদের ডকুমেন্টসগুলো বেশ সমৃদ্ধ, কিন্তু শিক্ষায় তোমরা এত পেছনে কেন। তাদের বলেছিলাম, আমাদের ডকুমেন্টসগুলোর প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় দেশের সবচেয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা থাকে; কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে তাদের অনেককেই দেখেছি শিক্ষায় তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি শিক্ষার কোনো প্রক্রিয়ায় তারা কখনোই সম্পৃক্ত ছিল না। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মতো বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া উচিত। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম এবং চলে গেলাম এই মুডে দায়িত্ব ও ক্ষমতা বণ্টিত হলে টেকসই উন্নয়ন যেমন হয় না, তেমনি জবাবদিহিতাও নিশ্চিত হয় না। ব্রিটিশরা এ দেশে যতটুকু উন্নয়ন করেছে বা তাদের শাসনব্যবস্থা যেভাবে সাজিয়েছিল, তার পুরোটাই ছিল স্বস্তিতে তাদের এ দেশে অবস্থান করা এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ও পূর্ণ কর্তৃত্বে এ দেশকে শাসন করা। অথচ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও আমরা একই অবস্থানে পড়ে আছি।
রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে শিক্ষকসমাজের এই দূরত্বের বিষয়টি ড. কুদরাত-এ-খুদা মনে হয় সর্বপ্রথম কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি তার শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের ২২.২৬-এ উল্লেখ করেন, ‘শিক্ষকদের জন্য বার্ষিক পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং এই পুরস্কারগুলো প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিনে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদান করতে হবে। পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষকের কর্মদক্ষতা সংবাদপত্র, রেডিও এবং সিনেমার মতো মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’ কিন্তু আমরা স্পষ্টতই লক্ষ করেছি, বিসিএস প্রশাসন ও বিসিএস পুলিশসহ হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডার অফিসারের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে সরকারপ্রধানকে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করতে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের এইরূপ কোনো অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধানের উপস্থিতির কোনো তথ্য আমার জানা নেই।
সারা দেশে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় ১৬ হাজার সদস্য, ৬ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রায় ২৪ লাখ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করে আসছে। দেশে এমন অনেক সরকারি কলেজ রয়েছে, যেগুলো অত্র অঞ্চলের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে মানবসম্পদে পরিণত করার দায়ভার নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছে। এই বিশাল সংখ্যাকে যেমন উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই, তেমনি দেশের শিক্ষার্থীর এই বিরাট অংশকে মানবসম্পদে পরিণত করার মানসে কর্মরত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। এই বিশাল কর্মীবাহিনীকে পেছনে রেখে একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না।
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এ কথা স্পষ্টতই বলা যায়, শিক্ষাকে টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট অর্জন ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, এ দেশের কোনো সরকারই ততটা গুরুত্ব দেয়নি। কাজেই কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশকে এখনই শিক্ষায় জিডিপি বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেখানে শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ ৪.৫-এর ওপরে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ (২০২১) ৪.৬৩ এবং মালদ্বীপের (২০২২) ৪.৫৮। অন্যদিকে শিক্ষায় বাংলাদেশের (২০২২) জিডিপির বরাদ্দ মাত্র ১.৯৭। অথচ শিক্ষায় বাংলাদেশে জিডিপি বরাদ্দ আরো ১ শতাংশ বৃদ্ধি করলে শিক্ষার গুণগত মানে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাংলাদেশ কি এই মুহূর্তে শিক্ষায় এত বরাদ্দ রাখবে, নাকি উন্নত রাষ্ট্র গঠনের দিকে অধিকতর মনোযোগী হবে? ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উন্নত রাষ্ট্রের কিছু পরিসংখ্যানিক তথ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
উপরিউক্ত পরিসংখ্যানের আলোকে বলা যায়, উন্নত রাষ্ট্রগুলো শিক্ষা ও গবেষণায় যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ নিশ্চিত করেছে, তাদের দেশের শিক্ষকতা পেশাকে মেধাবীদের জন্য আকর্ষণীয় করেছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুধু তাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে তা নয়, তারা সারা বিশ্ব থেকে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তারা শুধু শিক্ষায় সাফল্য পায়নি, তাদের যুগান্তকারী গবেষণা, আবিষ্কার ও উন্নত মানবসম্পদ যুগ যুগ ধরে তাদের অর্থনৈতিক, সামরিকসহ সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে টিকিয়ে রেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ যদি শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে, মেধাবীদের জন্য শিক্ষকতাকে আকৃষ্ট না করে, দায়সারাভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যায়, তাহলে হয়তো বাংলাদেশ কোনো একদিন উন্নত রাষ্ট্র হলেও হতে পারে; তবে তখন বাংলাদেশ হবে একমাত্র উন্নত রাষ্ট্র, যারা উন্নয়নের উপরিউক্ত প্যারামিটার স্পর্শ না করেও উন্নত রাষ্ট্র!!
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস