অনলাইন ডেস্ক : এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, যার আছে ভূরি ভূরি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রা কাব্যগ্রন্থের দুই বিঘা জমি কবিতার এই বিখ্যাত লাইনটি অনেকটাই মিলে যায় জাতীয় সংসদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর বেলায়। রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীতে পাঁচটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাটের অর্ধেক মালিকানা থাকার পরও প্রভাব খাটিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ১০ কাঠা আয়তনের একটি প্লট নিয়েছেন তিনি। ২০২২ সালে বিশেষ কোটায় (১৩/এ ধারায়) প্লটটি বরাদ্দ নিয়েছেন। প্লটের মূল্য বাবদ ৩৪ লাখ ২৭ হাজার ৫৪৪ টাকা পরিশোধ করলেও এর বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। রাজউক থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের বিষয়ে বলেন, তার হাতে ২৭ লাখ ৭২ হাজার ও স্বামীর নামে ১০ লাখ ৭৯ হাজার, বৈদেশিক মুদ্রা ৬ লাখ ৩০ হাজার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৭৭ লাখ ৯৩ হাজার এবং স্বামীর নামে ৭ লাখ ১৩ হাজার, পোস্টাল ও সেভিংস ১ কোটি ১০ লাখ ২১ হাজার এবং স্বামীর নামে ২১ লাখ ৭৫ হাজার, নিজের নামে দুটি গাড়ি, ৩ লাখ ৪০ হাজার স্বর্ণালংকার ও স্বামীর ৩০ তোলা স্বর্ণ, ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিকসসামগ্রী এবং ২ লাখ ৯০ হাজার টাকার আসবাবপত্রসহ ৩ কোটি ২২ লাখ ৭১ হাজার ৬১০ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।
স্থাবর সম্পদ : শিরীন শারমিন চৌধুরী হলফনামায় উল্লেখ করেন, তার ঢাকায় পাঁচটি বাড়ি/ফ্ল্যাট রয়েছে। যার ঠিকানা হচ্ছে বনানী এ-ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ১০৭ নম্বর বাড়ি। এ ছাড়া তিনি ধানম-ি আবাসিক এলাকার ১৬ নম্বর সড়কের ৫২ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটের ৫০ শতাংশ মালিক। উত্তরাধিকার সূত্রে এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন।
জানা গেছে, অভিজাত এলাকায় বাড়ি/ফ্ল্যাট থাকার পর শিরীন শারমিন ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাজউকের একটি প্লট বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেন। তিনি আবেদনে উল্লেখ করেন, ‘অদ্যাবধি রাজউক বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা থেকে কোনো বাড়ি বা জমি বরাদ্দ পাইনি। সদয় বিবেচনার অধীন আমাকে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে একটি প্লট বরাদ্দ প্রদান করা হলে বাধিত থাকব।’ প্রধানমন্ত্রী ওই আবেদন অনুমোদন দেওয়ার পর সেটি গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজউক চেয়ারম্যানের দপ্তরে যায়। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিষয়টি ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজউকের ৪/২০২২তম বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হয়। রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ডসভায় সদস্য হিসেবে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মো. শফি উল হক, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মুনির হোসেন খান, সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন-২) কাজী ওয়াছি উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। সভায় আলোচনার ভিত্তিতে শিরীন শারমিন চৌধুরীকে ১০ কাঠা আয়তনের একটি প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের জন্য এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার পরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের ৭ জুন তাকে পূর্বাচল প্রকল্পের ২৬ নম্বর সেক্টরের ২০১ নম্বর সড়কের ২৮ নম্বর প্লটটি চূড়ান্ত বরাদ্দ দেয় রাজউক। তিনি প্লটের মূল্য হিসেবে ৩৪ লাখ ২৭ হাজার ৫৪৪ টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু প্লটের বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
রাজউকের একজন সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক মানুষের আবাসনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই রাজউকের আবাসিক প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পে যাদের আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে, তারাই প্লট বেশি পেয়েছেন। আর বিশেষ কোটায় প্লট পেয়েছেন এমপি-মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সরকারি চাকরিজীবীরা। যাদের বাড়ি-গাড়ি আছে, তাদেরই প্লট দেওয়া হয়েছে। এক কথায় যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের দেওয়া হয়েছে। এসব প্লট বরাদ্দের মাধ্যমে ধনীদের আরও ধনী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
শিরীন শারমিন চৌধুরী ১৯৬৬ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। নোয়াখালীর চাটখিলের বাসিন্দা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর মেয়ে তিনি। আর মা ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক নাইয়ার সুলতানা। তার নানা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি সিকান্দার আলী। তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসেন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।
শিরীন শারমিন চৌধুরী বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল নবম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ৪৬ বছর বয়সে তিনি সর্বকনিষ্ঠ স্পিকার হিসেবে সাবেক স্পিকার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হন। এর আগে তিনি সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি পুনরায় জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আবার স্পিকারের দায়িত্ব পান।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে গেলে পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। ওইদিন তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান। এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস