অনলাইন ডেস্ক : এতদিন পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার রীতি ছিল। তবে সেটাও মানতে অনুৎসাহ দেশের প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর। এখন থেকে বছর বছর হিসাব দিতে হবে কড়ায়-গণ্ডায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে ব্যর্থ হলে কিংবা কোনো ভুল তথ্য দিলে, কিছু গোপন করলে বা সম্পদের কোনো রকম অসংগতি দেখা গেলে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সম্পদের তথ্য নিলেও তা কোনোভাবে প্রকাশ করবে না সরকার। এ ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনেও জানা যাবে না কারোর সম্পদের হিসাব।
এই পটভূমিতে চলতি বছরের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব সরকারি চাকুরেকে সম্পদের হিসাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আর বাকি মাত্র ৬৯ দিন। তবে ২০২৫ সাল থেকে প্রতিবছরের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার শেষ সময় হবে ৩১ ডিসেম্বর। সরকারি কর্মচারীরা সর্বশেষ ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিজ নিজ সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর আবার তারা নিজ নিজ সম্পদের হিসাব কষতে যাচ্ছেন।
সরকারি কর্মচারীর মধ্যে যাদের আয় করসীমার নিচে, তারা রিটার্ন জমা দেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, আয়কর রিটার্ন জমা দিক বা না দিক– সবাইকে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, আয়কর রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণীর কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারি কর্মচারী ও তার ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদের তথ্য নির্দিষ্ট ফরমে জমা দিতে হবে। যদিও অতীতে দেখা গেছে, দুর্নীতিবাজ অনেক সরকারি কর্মচারী মা-বাবা ও শ্বশুর–শাশুড়ির নামে অবৈধ সম্পদ করতেন। প্রকৃতভাবে এসব সম্পদের সুফলভোগী সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারী। তবে এসব বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, ঘটা করে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেওয়ার আয়োজন চললেও কারোর আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বিপুল সম্পদ থাকলে তা খুঁজে বের করার বা কেউ অসত্য তথ্য দিলে তা যাচাই করার কোনো কৌশল এখনও সরকার নির্ধারণ করতে পারেনি। গতকাল এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, কৌশল বের হয়ে যাবে। অনেকের পেছনে শত্রু লেগে থাকে, তারাই জানিয়ে দেবে। এ ছাড়া আমরা প্রাপ্ত সব তথ্য অনলাইনে সংরক্ষণের কথা ভাবছি। অস্বাভাবিক সম্পদ বেড়ে গেলে সেখানে নির্দিষ্ট ক্যাটেগরির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় আমরা সংকেত পেয়ে যাব। সম্পদের তথ্য যাচাইয়ের কৌশল আমরা বের করে ফেলব।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক জ্যেষ্ঠ সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর সম্পদের তথ্য যাচাই এত সোজা না। এটা বিপুল কর্মযজ্ঞ। এই পরিমাণ জনবল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নেই। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারী দেশের রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত আছে। বাস্তবে সবার সম্পদের তথ্যের সত্যতা যাচাই দুরূহ কাজ।
এদিকে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব প্রতিবছর নেওয়ার বিধান সাধুবাদ যোগ্য। আরও আগেই তা নিশ্চিত করা গেলে ভালো হতো। তবে সম্পদের হিসাব নিয়ে তা বস্তাবন্দি করে রাখলে হবে না। পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হবে। সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর ও রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিতের জন্য এটা খুবই জরুরি।তিনি বলেন, জনবলের ঘাটতি পূরণ করতে প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আলাদা একটি উইং খোলা যেতে পারে। যাতে সেখানে সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই করা যায়।
প্রতিবছর দিতে হবে হিসাব
আগে প্রতি পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান থাকলেও এখন থেকে প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্য সরকারি চাকরিজীবীকে সম্পদের হিসাব নিজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। জমা না দিলে তা ‘চাকরিতে অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য ও বিভাগীয় শাস্তি হবে। জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, বছর বছর সম্পদ বিবরণী দেওয়া হলো তার (কর্মচারীদের) জন্য একটা লাগাম। দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। আমাদের করা লাগবে না, দেখবেন অফিসই করবে। আর আমাদের বহু লোক আছে, কার কত সম্পদ তা নিজেরাই বলে দেবে।
হিসাব কীভাবে
ক্যাডার ও নন-ক্যাডার (নবম বা তদূর্ধ্ব গ্রেড) কর্মকর্তাকে তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিবের কাছে সম্পদ বিবরণী দিতে হবে। আর গেজেটেড, নন-গেজেটেড কর্মকর্তা-কর্মচারীরা (দশম থেকে ২০তম গ্রেড) নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদ বিবরণী দেবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ছকে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। ছকটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা যাবে। সম্পদের হিসাব সিলগালা করা খামে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে।
ফরমে কী তথ্য থাকবে
ফরমে ১৭টি তথ্য দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে– সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীর নাম, পরিচিতি নম্বর, পদবি, ক্যাডার, বর্তমান কর্মস্থল, চাকরিতে যোগদানের তারিখ, যোগদানকালে পদবি, স্থায়ী ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর/জন্মনিবন্ধন, আয়কর সনদ (টিন) নম্বর, বেতন স্কেল, মূল বেতন, ই-মেইল ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা।
মোট তিনটি ফরমের মধ্যে ‘ক’ ফরমের ১৭ নম্বরে কর্মচারীর স্বামী/স্ত্রী/সন্তানের বিস্তারিত তথ্য ও তাদের সম্পদের হিসাব। ‘খ’ ফরমে সাতটি রো ও আটটি কলাম রয়েছে। এই ফরমে স্থাবর সম্পদের হিসাব, সম্পদের অবস্থান ও বিবরণ, দাগ, খতিয়ান ও হোল্ডিং নম্বর, সম্পদটি অর্জনের ধরন (উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান, অন্যান্য) সম্পত্তির পরিমাণ, অর্জনের তারিখ, ক্রয়মূল্য, ক্রয় হলে অর্থের উৎস, জমি, কৃষি, অকৃষি, ইমারত, বসতভিটা, খামার, বাগানবাড়ি ইত্যাদির তথ্য দিতে হবে। ‘গ’ ফরমে আটটি কলাম রয়েছে। সেখানে দিতে হবে দায়দেনার তথ্য। ঋণ, যার নামে নেওয়া, ঋণদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, ঋণের ধরন, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ও মন্তব্য কলামও রয়েছে।
প্রকাশ করা হবে না সম্পদের হিসাব
সম্পদ বিবরণী সরকার নিলেও তা প্রকাশ করা হবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, আদালতের আদর্শ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সম্পদ বিবরণীর তথ্য সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ হস্তান্তরযোগ্য নয়। সম্পদ বিবরণী অতি গোপনীয় দলিল হওয়ায় এ ক্ষেত্রে ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’ প্রযোজ্য হবে না।
হিসাব জমা না দিলে কঠোর শাস্তি
সম্পদ বিবরণী জমা না দিলে কী হবে– এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড. মো. মোখলেস উর রহমান। তিনি বলেন, জমা না দিলে খবর আছে। ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’-এর ৪(৫)(গ) উপবিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর জন্য লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড আরোপের বিধান রয়েছে। তিরস্কার, পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, দায়িত্বে অবহেলার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ আদায়, বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিত করা হচ্ছে লঘুদণ্ড। অন্যদিকে, গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে– নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিত করা, বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ ও চাকরি থেকে বরখাস্ত।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস