ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে আজ বুধবার শুরু হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পাঁচ দিনের এই উৎসব আনন্দমুখর করে তুলতে নানা আয়োজন করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। মণ্ডপে মণ্ডপে হবে দেবী দুর্গার আরাধনা। এবার সারাদেশে দুর্গাপূজা হচ্ছে ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপে, যা গতবারের চেয়ে ৯৪৭টি কম।
শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তা সত্ত্বেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের শঙ্কা। তবে নিরাপদে ও উৎসবের আমেজে পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন তারা।
উল্লেখ্য, ১৩ অক্টোবর বিজয়া দশমীর ছুটি। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। ফলে মাঝখানের শুক্র ও শনিবার মিলিয়ে এবার দুর্গাপূজায় চার দিনের ছুটি মিলছে। জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, ‘ছুটি বাড়ানোর এমন ঘটনা অতীতে ঘটেনি।’
ছুটি বাড়ানোকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। গতকাল পরিষদের এক বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানানো হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমা ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডেতেও সরকার এমন পদক্ষেপ নেবে বলে বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করে ঐক্য পরিষদ।
দুর্গোৎসব উপলক্ষে পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ ছাড়া শুভেচ্ছা জানিয়েছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটিসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা।
মহাষষ্ঠী আজ
শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রথম দিন মহাষষ্ঠী আজ। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে দেবীর ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা শুরু হবে। সায়ংকালে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল দুর্গোৎসব। এর আগে ২ অক্টোবর দেবী দুর্গার আবাহন বা মহালয়ার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। সাধারণত দেবীপক্ষ শুরুর সাত দিন পর দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। গতকাল মহাপঞ্চমীতে সন্ধ্যায় দেবীর বোধন হয়। এর মাধ্যমে দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙার জন্য বন্দনাপূজা করা হয়। এ সময় চণ্ডীপাঠে মুখর ছিল মণ্ডপ-মন্দির।
নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, আগামীকাল দুর্গোৎসবের মহাসপ্তমী। এর পর শুক্রবার মহাষ্টমী ও কুমারীপূজা এবং শনিবার মহানবমী। তবে পঞ্জিকামতে, শনিবার মহানবমী পূজার পরই দশমীবিহিত পূজা হবে। আর রোববার বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে উৎসব শেষ হবে। ওই দিন বিকেলে বিজয়ার শোভাযাত্রা করে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে। পূজার প্রতিদিনই মণ্ডপে অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ-আরতির আয়োজন রয়েছে। দুর্গোৎসব চলাকালে দেশজুড়ে মণ্ডপে মণ্ডপে আলোকসজ্জা, আরতি, স্বেচ্ছায় রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, নাটক, নৃত্যনাট্যসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার দোলায় (পালকি) চড়ে স্বর্গালোক থেকে মর্ত্যলোকে আসবেন। যার ফল হলো– এবার মড়ক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারি বাড়বে। দেবী স্বর্গালোকে ফিরবেন গজে (হাতি) চড়ে। যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে।
পুরাণমতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। তিনি বসন্তে এই পূজার আয়োজন করায় একে বাসন্তীপূজা বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কাযাত্রার আগে রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেন শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে, যা শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। শরৎকালের পূজাকে এ জন্য অকাল বোধনও বলা হয়।
কড়া নিরাপত্তা, থাকছে সেনাবাহিনী
ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিটি পূজামণ্ডপে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও নাশকতা ঠেকাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি সেনাসদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। সারাদেশে দুই লাখের বেশি আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে কোস্টগার্ড। এর আগে সরকারের উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধান ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন। ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে খোলা হয়েছে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
মণ্ডপ-মন্দিরে প্রস্তুতি
শারদীয় দুর্গাপূজার বড় আয়োজন রয়েছে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পূজামণ্ডপে। পূজার পাশাপাশি এখানে সংগীতানুষ্ঠান, দুস্থদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, প্রসাদ বিতরণ, আরতি প্রতিযোগিতা ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি রয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ পূজামণ্ডপে মহাষ্টমী ও কুমারীপূজার দিন প্রসাদ বিতরণ করা হবে। নিরাপত্তার কারণে এবার কুমারীপূজা না করার সিদ্ধান্ত নিলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সেটি করার সিদ্ধান্ত নেয় মিশন কর্তৃপক্ষ।
বনানী পূজামণ্ডপে পাঁচ দিনই বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে। উত্তরা সার্বজনীন পূজামণ্ডপ, রাজারবাগের বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান কমিটির পূজামণ্ডপ, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির পূজামণ্ডপ এবং জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দিরে পূজার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনের ভোলানন্দগিরি আশ্রম, রাধিকা বসাক লেন, নবেন্দ্র বসাক লেন, ঢাকেশ্বরীবাড়ি, শাঁখারীবাজারের পান্নিটোলা, টিকাটুলীর প্রণব মঠ, ঠাঁটারীবাজার পঞ্চানন শিবমন্দির, সূত্রাপুরের ঋষিপাড়া গৌতম মন্দির, বনগ্রাম তরুণ সংসদ, ওয়ারী সার্বজনীন পূজা কমিটির মণ্ডপ, উত্তর মৈশুণ্ডি, ফরাশগঞ্জ জমিদারবাড়ি, বিহারীলাল জিও মন্দির এবং মতিঝিলের অরুণিমা সংসদ পূজা কমিটির মণ্ডপে দুর্গোৎসবের ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
পূজা কমেছে সারাদেশে
ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে শরীয়তপুরে পূজামণ্ডপ বাড়লেও বাকিগুলোতে কমেছে। শরীয়তপুরে পূজা হচ্ছে ১০২টি মণ্ডপে, যা গত বছর ছিল ৯৮টি। টাঙ্গাইলে ১৮৪টি পূজা কমেছে। জেলায় এবার ১ হাজার ১০৪টি মণ্ডপ স্থাপন হয়েছে, যা গত বছর ছিল ১ হাজার ২৮৮টি। এ ছাড়া গোপালগঞ্জে আটটি, মাদারীপুরে ৩৪টি, রাজবাড়ীতে দুটি, ফরিদপুরে ৮০টি, গাজীপুরে ৭৮টি, মুন্সীগঞ্জে একটি, কিশোরগঞ্জে ৩৯টি, নারায়ণগঞ্জে একটি, মানিকগঞ্জে ৫১টি ও নরসিংদীতে একটি পূজা কম হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ হাজার ৭৩০টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৮৮৯, অর্থাৎ কমেছে ১৫৯টি পূজা। খুলনায় ৫৬৪টি মণ্ডপ কমেছে। এবার এখানে পূজা হচ্ছে ৪ হাজার ৫৬৩টি। রংপুরে বিভাগে গত বছর ৫ হাজার ৫১৩টি মণ্ডপে পূজা হলেও এবার হচ্ছে ৫ হাজার ২২৭টিতে। কমেছে ২৮৬টি পূজা। সিলেট বিভাগে পূজা কমেছে ১৭টি। এ বছর বিভাগে ২ হাজার ৬৭৫টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ২ হাজার ৬৯২টি। বরিশালে ২৩৪ মণ্ডপে এবার দুর্গাপূজা হচ্ছে না। এই বিভাগে পূজা হচ্ছে ১ হাজার ৬৭৬টি মণ্ডপে, যা গত বছর ছিল ১ হাজার ৯১০টি।
ময়মনসিংহে পূজামণ্ডপ কিছুটা বাড়লেও কমেছে বিভাগের অন্য তিন জেলায়। এর মধ্যে নেত্রকোনায় ৯৫টি ও জামালপুরে ১৮টি পূজা কমার তথ্য মিলেছে। রংপুর জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি রামজীবন কুমার কুণ্ডু বলেন, সরকার পতনের পর পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে মন্দা ভাব বিরাজ করায় এবার পূজা কমেছে।