অনলাইন ডেস্ক : ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর থেকে নানা আলোচনা চলছে যে তিনি কি শেষ পর্যন্ত ভারতেই থাকবেন নাকি অন্য কোন দেশে আশ্রয় নেবেন? সম্প্রতি আবারো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলছেন যে শেখ হাসিনা ভারতে থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছেন। তবে দিল্লির দাবি হাসিনা ভারতেই আছেন। অবস্থান পরিবর্তন করেনি তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা বক্তব্যের বিষয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকরা জানতে চান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে।
জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ওনার অবস্থান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। আমরা দিল্লিতে খোঁজ করেছি, আমিরাতেও খোঁজ করেছি, কনফারমেশন অফিসিয়ালি কেউ দিতে পারেনি। উপদেষ্টা বলেন, আপনারাও যেমন দেখেছেন, আমরাও দেখেছি উনি আজমানে সম্ভবত গেছেন। কিন্তু এটা রিকনফার্ম করার চেষ্টা করেও আমরা সফল হইনি। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন। শেখ হাসিনা দিল্লি ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে চলে গেছেন – এ জাতীয় সব খবরকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার দেশে ফিরেছেন। অনেকে আবার দেশ ছেড়ে যাননি। যেসব স্বৈরশাসক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় তারা কোথায় যায়? যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির দ্য জার্নাল অব পলিটিক্স-এ আবদেল এসক্রিবা এবং ড্যানিয়েল ক্রাকমারিক এক গবেষণামূলক নিবন্ধে লিখেছেন, স্বৈরশাসকরা পালিয়ে যেসব দেশে আশ্রয় নিতে চায় সেখানে বেশ কয়েকটি বিষয় বিষয় কাজ করে।
এগুলো হচ্ছে
- একটি দেশের সাথে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মিল কতটুকু আছে
- ভৌগোলিক দূরত্ব কতটা
- দেশটি অতীতে কোন স্বৈরাচারদের আশ্রয় দিয়েছে কী না
- দেশটি সামরিকভাবে শক্তিশালী কী না।
ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচাররা সাধারণত গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে আশ্রয় নিতে চায় না বলে উল্লেখ করেন আবদেল এসক্রিবা এবং ড্যানিয়েল ক্রাকমারিক। অতীতে দেখা গেছে, মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারদের অনেকেই সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছে। ২০২২ সালে মিডল ইস্ট আই পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সৌদি আরব যাদের আশ্রয় দিয়েছে তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে খরচ বহন করেছে সৌদি সরকার। এছাড়া পশ্চিমা দেশে আশ্রয় নেবার নজিরও রয়েছে।
ইউক্রেনের ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ
ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়া-পন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যদিও তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার রাশিয়া-পন্থী নীতির প্রতিবাদে ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে বিরোধীরা রাজধানী কিয়েভ দখল করে নেয়। তখন ইউক্রেনের পার্লামেন্ট মি. ইয়ানুকোভিচকে বরখাস্ত করে এবং তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে যান। তখন থেকে তিনি রাশিয়াতে অবস্থান করছেন।
উগান্ডার ইদি আমিন
১৯৭০’র দশকে উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন ক্ষমতায় থাকার সময় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার-বহির্ভূত হত্যা এবং দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন। জনরোষের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ১৯৭৯ সালে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন আমিন। তিনি তখন সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে এর আগে কিছুদিন তিনি লিবিয়া এবং ইরাকে অবস্থান করেছিলেন।
প্রায় দুই দশক সৌদি আরবের জেদ্দায় লোহিত সাগরের পাশে বিলাসবহুল বাড়িতে তিনি কাটিয়েছেন। এসময় তার যাবতীয় খরচ বহন করেছিল সৌদি সরকার। ১৯৯৯ সালে উগান্ডার সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমি এখানে ভালো আছি। নিরিবিলি জীবন-যাপন করছি। ২০০৩ সালে রিয়াদের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
তিউনিসিয়ার বেন আলী
২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিাকার কয়েকটি দেশে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হলে ক্ষমতাচ্যুত হন তিউনিসিয়ার বেন আলী। তেইশ বছর দেশ শাসন করার পর গণ-আন্দোলনের মুখে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বেন আলী যখন সৌদি আরবে ছিলেন, তখন তার সম্পর্কে খুব কম তথ্য জানা গিয়েছিল। শুধু ২০১৩ ইন্সটাগ্রামে বেন আলীর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি বের হয়েছিল। জেদ্দার একটি হাসপাতালে ২০২৩ সালে তিনি মারা যান।
আফগানিস্তানের আশরাফ ঘানি
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবান যোদ্ধারা বেশ দ্রুত রাজধানী কাবুল দখল করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। এসময় রাজধানী কাবুল থেকে পালিয়ে যান দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। প্রথমে তার গন্তব্য নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও পরবর্তীতে জানা যায়, ঘানি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় নিয়েছে। তখন তিনি বলেছিলেন, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য তিনি আফগানিস্তান ছেড়েছেন।
ফিলিপিনসের মার্কোস
জনবিক্ষোভ ও বিরোধীদের প্রতিরোধের মুখে ১৯৮৬ সালে ফিলিপিনসের প্রেসিডেন্ট মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মি. মার্কোস যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান-এর পরামর্শে মার্কোস তখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়াম -এ আশ্রয় নেন।
মার্কোসকে দেশ ছেড়ে পালাতে সহায়তা করেছিলে আমেরিকান এয়ারফোর্সের একটি বিমান। মি, মার্কোস পালিয়ে যাবার ফিলিপিন্স-এর হাজার হাজার মানুষ দেশটির রাস্তায় রাস্তায় আনন্দ উদযাপন করেছে। ১৯৮৯ সালে ৭২ বছর বয়সে মার্কিন দ্বীপ হাওয়াইয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান মার্কোস।
মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি
ইরানের রাজতন্ত্রের শেষ শাসক ছিলেন মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি, যিনি অনেকের কাছে ‘ইরানের শাহ’ হিসেবে পরিচিত। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি। ফ্রান্সে বসে সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি। আন্দোলন ও প্রতিরোধের মুখে রেজা শাহ পাহলভি প্রথমে যান মিশরে। সেখান থেকে মরক্কো, বাহমা দ্বীপপুঞ্জ এবং মেক্সিকো হয়ে আমেরিকা যান রেজা শাহ।
তিনি আমেরিকা যাবার পর তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস দখল করে কূটনীতিকদের জিম্মি করে ইরানের বিপ্লবীরা। তখন তারা জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে আমেরিকার কাছ থেকে রেজা শাহকে ফেরত দেবার দাবি করে। কিন্তু আমেরিকা রেজা শাহকে হস্তান্তর না করলেও তিনি আমেরিকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে পানামা হয়ে আবার মিশরে যান রেজা শাহ পাহলভি। মিশর তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে ষাট বছর বয়সে কায়রোতে মারা যান মোহাম্মদ রেজা পাহলভি।
পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানে নওয়াজ শরীফ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।তাকে দুর্নীতির মামলায় সাজাও দেওয়া হয়। এরপর সৌদি আরব ও আমেরিকার মধ্যস্থতায় তিনি নির্বাসনে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দ্বিতীয় দফায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে লন্ডনে গিয়েছিলেন নওয়াজ শরীফ ২০১৯ সালে। সেখান থেকে তিনি ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে দেশ ফিরে আসেন।
পাকিস্তানের পারভেজ মুশারফ পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ক্ষমতা নিয়েছিলেন নওয়াজ শরীফকে পদচ্যুত করার মাধ্যমে। মুশাররফ ২০০১ সালে থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০৮ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তিনি দেশ ছেড়ে যান। এর পাঁচ বছর পরে ২০১৩ সালে তিনি আবারো দেশে ফিরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেষ্টা করলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৬ সালে মি. মুশাররফ আবারো সরকারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে চিকিৎসার জন দুবাই যান এবং ২০২৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
থাইল্যান্ডের থাকসিন শিনাওয়াত
থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াতকে ২০০৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল দেশটির সেনাবাহিনী। থাকসিন পরিবার ও তাদের রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় থাকসিন শিনাওয়াত বিদেশে অবস্থান করছিলেন। সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবার পর মি. থাকসিন লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি ১৫ বছর নির্বাসনে ছিলেন। এরপর ২০২৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
চার্লস টেলর
লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলর দেশটিতে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি ছয় বছর লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। টেলরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছিল। সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধের সময় বিদ্রোহীরা গণহত্যা, ধর্ষণসহ যে নানা ধরনের অপরাধ করেছে, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিস্টার টেলর তাদের অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এছাড়া লাইবেরিয়ার ভেতরে বিরোধীদের উপর সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন টেলর। গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে ক্ষমতা ছেড়ে নাইজেরিয়ায় চলে যান তিনি। মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। চার্লস টেলরকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ৫০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দ্য হেগের বিশেষ আদালত এই রায় ঘোষণা করে।
শ্রীলঙ্কার গোটাবায়া রাজাপাকশা
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা ২০২২ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এর আগে আন্দোলনে শ্রীলঙ্কা জুড়ে কয়েক লাখ মানুষ সরকার ঘোষিত কারফিউ অমান্য করেছিল। টিয়ার গ্যাস, জল কামান উপেক্ষা করে তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। দেশ ছেড়ে পালিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরে আশ্রয় নেন। এরপর তিনি থাইল্যান্ডে যান। প্রায় দুই মাস পরে রাজাপাকশা আবার দেশে ফিরে আসেন।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস