আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২১শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, দুপুর ১২:১০
দেশেই কেন ইলিশের হাহাকার? দেশের মাছ কেন পাচ্ছেন না দেশের মানুষ

দেশেই কেন ইলিশের হাহাকার? দেশের মাছ কেন পাচ্ছেন না দেশের মানুষ

প্রকাশিতঃ

অনলাইন ডেস্ক : বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বিভিন্ন লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে বাংলার ইলিশের অতুলনীয় স্বাদ। ‘আড্ডা’ নামের এক প্রবন্ধে তিনি বেহেশতি খাবারের প্রসঙ্গ তুলে ইলিশকে ‘অমৃত’র আসনে বসিয়েছেন। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী জোরগলায় বলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাত আর ইলিশ। কিন্তু পাঞ্জাবি সেটা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, বিরিয়ানিই শ্রেষ্ঠ। এই নিয়ে মুজতবা আলী এমন খেপলেন যে ওই অধ্যাপকের সঙ্গে সপ্তাহখানেক আর কথাই বললেন না।

আজ যদি মুজতবা আলী বেঁচে থাকতেন, ইলিশের মহিমা প্রচারের আগে হয়তো এর দাম নিয়ে দশবার ভাবতেন। ভরা মৌসুমেই এখন ইলিশের বাজারে আগুন! সাধারণ মানুষের নাগাল শুধু না, ভাবনারও বাইরে চলে গেছে ইলিশ। কীভাবে হলো এই অবস্থা? ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারির সময় রপ্তানি-পাচার বন্ধ থাকায় দেশের মানুষ ইলিশ খেয়েছে তৃপ্তিমতো। ঢাকার ফুটপাতে গড়াগড়ি গেছে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ। দামেও ছিল সস্তা। কিন্তু এখন কেন ইলিশের হাহাকার? দামে আগুন? এটা কি শুধুই ভারতে রপ্তানির অজুহাতে? নাকি আগে থেকেই ঘটে আসা অন্য কোনো ঘটনা?

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ইলিশের অতি মূল্যের বিষয়টা তলিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে। একে একে বেরিয়ে আসে গভীর হতাশার সব চিত্র। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন; অন্যদিকে বহুদিন ধরে চলে আসছে নদী দখল-দূষণ আর ইলিশ কারবারিদের নেতিবাচক সব তৎপরতা। নিষিদ্ধ মৌসুমে ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা ও নিষিদ্ধ জালে পোনা-জাটকা শিকার চলে সারা বছর। সব মিলিয়ে ইলিশের দেশে এখন লেগেছে আকাল। জেলেদের জালে মিলছে না ইলিশ। যাই বা মেলে, তা নিয়ে শুরু হয় অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কাড়াকাড়ি আর কারসাজি। তাঁদের বহুচর্চিত দাদন চক্র জিম্মি করে রেখেছে বাঙালির সাধের ইলিশকে।

অনুসন্ধানে এই দাদন চক্রে অন্তত ৫টি ফাঁদের সন্ধান মিলেছে, যেখানে ওত পেতে থাকেন ৫ ধরনের কারবারি। তাঁরা প্রত্যেকেই একই সঙ্গে ইলিশের ক্রেতা ও বিক্রেতা; এবং তাঁদের মধ্যে মাঝখানের তিনজন আবার দাদনের (ঋণের আঞ্চলিক নাম) জালে বাঁধা। যে যাঁকে দাদন দিয়েছেন, তিনি শুধু তাঁর হাতেই ইলিশ তুলে দিতে বাধ্য; বাজার যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই কারও। এই অদ্ভুত বাজরব্যবস্থার মাঝে পড়েই দফায় দফায় দাম চড়ে ইলিশের।

অনুসন্ধানের একপর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, একদল জেলে জীবন বাজি রেখে, ৯ থেকে ১০ দিন সাগরে ভেসে যে মাছ ধরে আনলেন, তা বিক্রি হলো ৬ লাখ টাকায়। পরে দাদন চক্রের মারপ্যাঁচে দেখা গেল, ওই ৫ ধাপের কারবারি প্রত্যেকেই কমবেশি কয়েক হাজার করে টাকা পকেটস্থ করলেন; অথচ মাছশিকারি জেলেরা মাথাপিছু ৫৭১.৪২ টাকার দেনা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।

অনুসন্ধানে উঠে আসা আরও একটি হতাশার দিক হলো— দেশের গর্ব, অন্য দেশের ঈর্ষা আমাদের ‘জাতীয় মাছ’ যে ইলিশ, তার বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কোনো তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। ফলে বাঙালির জীবনের গোটা ইলিশ-পর্বটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে ওই দাদন চক্রের কাছে। এই আবর্তে পড়ে নদীর ‘বিনা পয়সা’র ইলিশের দামও চড়েছে আজ আকাশে। আমরা দেখেছি, দামের নাটাই ধরে আছেন ইলিশ কারবারের সবচেয়ে বড় পুঁজিপতিরা, যাঁদের বলা হয় ‘বড় আড়তদার’। এঁদের অবস্থান রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগরীতে। আমরা তাঁদের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছি এই ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে।

এই অনুসন্ধানে দেশের ইলিশ-অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ৪ জন প্রতিনিধি-প্রতিবেদককে নিয়োজিত করা হয়। তাঁরা নদ-নদী-সাগর-মোহনা; ইলিশের অভয়াশ্রম, ইলিশ-ঘাট, বাণিজ্যকেন্দ্র এবং খুচরা বাজারগুলোতে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন তথ্য-প্রমাণ। সেগুলো নিয়ে করা হয় বিশ্লেষণ-গবেষণা। তুলে ধরা হয় বিশেষজ্ঞদের কাছে। শরণ নেওয়া হয় আইনজ্ঞদের। তাঁদের বক্তব্য-মন্তব্যের সূত্র ধরে তালাশ করা হয় ইলিশ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা।

অনুসন্ধানকালে আমাদের এক প্রতিনিধিকে স্থানীয় আড়তদারদের একজন ঠোঁট বাঁকিয়ে শুনিয়ে দিয়েছেন, ‘দ্যাশের মানুষ, গরিব মানুষ করতেয়াছেন! হ্যারা ইলিশের দিকে তাকায় ক্যা? হ্যাগর লাগি তো এই মাছ না! এই মাছ খাইবে বড়লোকেরা…।’ কথাটা তুললে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বললেন, ‘কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি ইলিশের বাজার অস্থির করা হয় এবং এ কারণে দেশের নাগরিকেরা যদি ইলিশ খেতে না পারেন, তাহলে সেটি আইনগতভাবে নাগরিকের অধিকার খর্ব করার শামিল।’ গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পৌঁছান আমাদের পাথরঘাটা প্রতিনিধি আমিন সোহেল। আসুন, তাঁর চোখ দিয়ে দেখি সেখানকার ঘটনাপ্রবাহ :

ইজিবাইক থেকে নামতেই মানুষের কোলাহল। একটু এগোলেই পাইকারি মাছ বাজারের দোতলা ভবন। এটি ঘিরেই মাছ বেচাকেনা, প্যাকেজিং ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা চলে সারা দিনব্যাপী। বিএফডিসির এই মূল ভবনের পেছনের ঘাটে সারি সারি মাছের ট্রলার নোঙর করা। কয়েকটি ট্রলার থেকে মাছ খালাসের কাজ চলছে। একটির মাছ নামানো শেষ হতেই নিরাপত্তারক্ষীর বাঁশিতে ফুঁ। এবার ‘এফবি মরিয়ম’ নামের ট্রলারটি জেটির দিকে এগোতে থাকে। শক্ত হাতে সুকানি ধরে একজন ট্রলারটি ঘাটে ভেড়ালেন। ট্রলারের খোন্দল থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠল রুপালি ইলিশ।

সুকানি ধরা সেই মধ্যবয়সী হলা মাঝি (সহকারী মাঝি) এমাদুল হকের কাছে জানা গেল, ৭ দিন আগে তাঁরা সাগরে গিয়ে গত সন্ধ্যায় এই ঘাটে ফিরে নোঙর করেছেন। মূল মাঝিসহ অর্ধেক সদস্য চলে গেছেন বাড়িতে। অর্ধেক আছেন, মাছ বিক্রি হলে যাবেন। এই ট্রলারের মালিকের নাম জসীম উদ্দিন। তিনি ট্রলার বুঝিয়ে দেন মূল মাঝিকে। মাঝিই ঠিক করেন দলবল। যেমন ইউনুস মাঝি তাঁর সহকারী বা হলা মাঝি ১ জন, বাবুর্চি ১ জন, মিস্ত্রি ১ জন এবং জেলে ১৩ জন—নিজেসহ মোট ১৭ জনের দল গঠন করে উঠেছেন এফবি মরিয়ম ট্রলারে। পদবি ভিন্ন হলেও তাঁরা সবাই আসলে জেলে; সবাই অংশ নেন মাছ শিকারে।

খোন্দল থেকে জেলেরা ইলিশ তুলছেন আর ঘাটশ্রমিকেরা হাতে গ্লাভস ও সাজি নিয়ে লাইন দিয়ে ট্রলারের সামনে দাঁড়িয়েছেন। মাথায় মাথায় ঝাঁপি বদল করে ইলিশ নিয়ে তাঁরা ‘মেসার্স মা ফিশ’ নামক আড়তের চটে (মেঝেতে) ফেলছেন। এই আড়তের মালিকের নাম আব্দুস সালাম। চটে মাছ তোলা শেষ হতেই শুরু হলো নিলামের পালা। ঘিরে আছেন পাইকাররা। আড়তদার সালাম হাঁক তুললেন, ‘দাম কন, দাম কন…।’ আব্বাস হোসেন, বাচ্চু গাজী ও জাকির মুন্সি নামের ৩ পাইকার আঙুল দিয়ে টিপে টিপে ইলিশের অবস্থা পরখ করছেন দেখে আড়তদার বলে উঠলেন— ‘খারাপ না। দ্যাহন লাগবে না; একের (এক নম্বর) মাছ’ বলেই আবার হাঁক— ‘দাম কন, দাম কন।’

প্রথমেই ৫১ হাজার টাকা মণ দাম করলেন পাইকার জাকির মুন্সি। আড়তদার দুইবার ৫১, ৫১ হাজার বলতেই আরেক পাইকার বললেন, ‘৫২ হাজার’। আরেক পাইকার ৫৩; আরেকজন ৫৩ হাজার ৫০০। এভাবে বাড়তে বাড়তে এক পাইকার বলে বসলেন ‘৫৬ হাজার’। এবার সব যেন ঠান্ডা। আড়তদার আব্দুস সালাম ‘৫৬… ৫৬’ বললেও কেউ আর দাম বলছেন না। পরে ‘৫৬-১, ৫৬-২, ৫৬-৩’ বলেই আব্দুস সালাম শেষ করলেন নিলাম ডাকা। অবশেষে ৫৬ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়ে গেল এফবি মরিয়ম ট্রলারের সব ইলিশ। যে পাইকার কিনলেন, জানা গেল, তাঁর নাম বাচ্চু গাজী। তিনি পাথরঘাটারই বাসিন্দা। মরিয়ম ট্রলারের ৫ মণ ইলিশ ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় কিনে নিলেন পাইকার বাচ্চু গাজী। এ ছাড়া তিনি ওই ট্রলারের বিভিন্ন প্রজাতির আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মাছ নিলামে কিনলেন।

কেননা, ইলিশ-কারবারের এই গোটা চক্রে তিনিই মূল পুঁজিপতি। তাঁর দেওয়া দাদনের টাকা খাটিয়েই ঘাটে ঘাটে ইলিশ–কারবার চালু রেখেছেন পাইকার, আড়তদার, ট্রলারমালিকেরা। এই দাদনের কোনো কূল-কিনারা নেই। কোনো দলিল-দস্তাবেজ নেই। সব চলে মুখে মুখে পারস্পরিক নির্ভরতার দায়বদ্ধতা দিয়ে। এই বিষয়ে এবং ঢাকার মহাজন এই ইলিশ থেকে কত আয় করছেন; আর তাঁর কাছ থেকে খুচরা দোকানি কত বেশি দিয়ে কিনে সাধারণ ভোক্তার কাছে বিক্রি করে কত আয় করছেন, তার বিস্তারিত অনুসন্ধানের খবর থাকবে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্বে।

 

সংবাদদাতা/ ইলিয়াস

Facebook
WhatsApp
Twitter

এ সম্পর্কিত আরো খবর

সম্পাদকঃ

সুভাষ সাহা

যুগ্ন সম্পাদকঃ

কাজী কবির হোসেন

ঠিকানাঃ

নারায়ণগঞ্জ অফিসঃ
পদ্মা সিটি প্লাজা, কক্ষ নংঃ ২২২, ৫৫/বি
এস, এম মালেহ রোড, টানবাজার
নারায়ণগঞ্জ-১৪০০

যোগাযোগ

ফোনঃ ৭৬৪০৬৯৯
মোবাইলঃ ০১৭১১৫৬১৩৯০
ইমেইলঃ bisherbashi.com.bd@gmail.com

USA OFFICE:

Wasington DC Bureau Chief:
Dastagir Jahangir,
3621 Columbia Pike Suit #104
Arlington USA, VA
22204
Phone: 7036770679
Email: tugrilcz@gmail.com

 

Website Design & Developed By
MD Fahim Haque
<Power Coder/>
www.mdfahim.com
Web Solution – Since 2009

error: Content is protected !!