অনলাইন ডেস্ক : দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার শনাক্তের পাশাপাশি ২১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ জনেরই মৃত্যু হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন। এমনকি শক সিনড্রোম ও রোগীর শরীরে তরল ব্যবস্থাপনা (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) জটিলতায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক চিকিৎসক।
তবে, প্রতি বছরের মতো অনেক প্রস্তুতি সত্ত্বেও কেন এবারও আক্রান্ত ও মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না, এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এক্ষেত্রে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, দেশের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার গোড়াতেই গলদ রয়েছে। যে কারণে এক দপ্তর অন্য দপ্তরের ওপর শুধু দায় চাপিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত একদিনে (১৩ অক্টোবর) দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে এ সময়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৬৬০ জন। এ নিয়ে এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার ৪৭০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ২১৪ জনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক সিনড্রোম ও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট জটিলতায় বেশি মৃত্যু হলেও এর বাইরে দেরিতে হাসপাতালে আসা, চিকিৎসা পেতে বিলম্ব, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ এবং একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তও দায়ী। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগকেই মূল নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
রুরাল (গ্রামীণ) এরিয়ার প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবার সব দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে থাকলেও আরবান (শহর) এরিয়ায় বড় একটি দায়িত্ব পালন করে সিটি কর্পোরেশন, যা দুই দপ্তরে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা তৈরি করে। তাই ‘প্রাইমারি হেলথ কেয়ার’ নামক একটি পৃথক অধিদপ্তর করে এর অধীনে আরবান এরিয়ার প্রাইমারি হেলথকে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী মিয়া।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আরবান এরিয়ায় প্রাইমারি হেলথ কেয়ার একটি নেগলেক্টেড ইস্যু। তাই ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে শুরু করে ‘নিয়ন্ত্রণযোগ্য’ নানা সংক্রমণ ও রোগ-বালাইকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, প্রাইমারি হেলথ কেয়ারকে দেখাশোনার জন্য পৃথক একটি ডিরেক্টরেট হয়ে গেলে এবং এর মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাতে চলে এলে ডেঙ্গুসহ নানা সমস্যার সমাধান চলে আসবে।
ডা. খোরশেদ আলী বলেন, একটা সময় শহর এলাকার রোগ নিয়ন্ত্রণ, রোগ নিরাময়, মশার ওষুধ ছিটানোসহ এ জাতীয় বিষয়গুলো মফস্বল এলাকাগুলোর মতোই স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে ছিল। কিন্তু আশির দশকের শেষদিকে এটা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে চলে যায়। আমরা যদি দেখি, রোগ প্রতিরোধ করার কার্যক্রমটা গ্রাম এলাকায় যতটুকু শক্তিশালী, শহুরে এলাকায় অতটা না। এজন্য আমি মনে করি পলিসি লেভেলে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত এবং স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও শক্তিশালী করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার কখনোই সিটি কর্পোরেশনের কাজ নয়। সিটি কর্পোরেশনের এমনিতেই অনেক কাজ। ওয়াসা-পুলিশিং থেকে শুরু করে নানা কার্যক্রমে তাদের বিস্তৃতি অনেক। যে কারণে এত কাজের মধ্যে স্বাস্থ্যের বিষয়টা তাদের কাছে অনেকটা নেগলেক্টেড ইস্যু। এ জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কাজই নেই। যে কারণে শহর এলাকাগুলোতে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের বিষয়টা অনেকটা এতিমের মতো পড়ে আছে। এজন্য আমরা চাইব প্রাইমারি হেলথ কেয়ার থেকে একটা ডিরেক্টরেট করে এর অধীনে আরবান এরিয়ার প্রাইমারি হেলথকে নিয়ে আসা হোক। তাহলে আমাদের ডেঙ্গু সমস্যার মতো আরও অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে।
দায় শুধু সরকারের নয়, নিজেদেরও– এমনটা ভাবতে হবে
ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধের দায় শুধু সরকারেরই নয়, ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী। তিনি বলেন, আমরা সবসময় মনে করি ডেঙ্গুর বিষয়টি বৃহৎ আকারের কিছু, তাই এর সব দায়দায়িত্ব সরকারের— এটি মোটেও ঠিক নয়। ধরুন, আমার বাসার সামনেই রাস্তায় ছোট ছোট গর্ত হয়ে আছে, বাসার ছাদের ফুলের টবে পানি জমে আছে। এগুলো তো সরকার এসে পরিষ্কার করে দিতে পারবে না। পাঁচ মিলিগ্রাম পানিও যদি কোথাও ৭২ ঘণ্টার বেশি থাকে, সেখানেই ডেঙ্গু মশার জন্ম হতে পারে। এ অবস্থায় আমাদেরই ছোট ছোট কাজগুলোতে নজর দিতে হবে। এমনকি নিজ উদ্যোগেই নিজ নিজ প্রতিবেশীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
বিশিষ্ট এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ডেঙ্গুর মাইক্রো অর্গানিজমের মিউটেশন হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সবসময় নজর রাখতে হবে। যদি মিউটেশন হয়, তাহলে তার ক্যারেক্টারে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, এর কার্যকারিতা কতটা তীব্র— বিষয়গুলোতেও সতর্ক থাকতে হবে। কাজটা মূলত ভাইরোলজিস্টরা করে থাকেন। এজন্য আমার মনে হয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চারটি সেক্টর (ভাইরোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ক্লিনিশিয়ান ও পাবলিক হেলথ) খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এ জায়গায় আমাদের সমন্বয়টা ঠিকমতো হচ্ছে না।
এবারও ‘ডেন-২’-এর প্রাধান্য
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর গত এক মাস ধরে ডেঙ্গুর সেরোটাইপ নিয়ে গবেষণা করছে। এতে দেখা গেছে, এবারও ডেঙ্গুর চার সেরোটাইপ বা ধরনের মধ্যে ‘ডেন-২’ এর প্রাধান্য বেশি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু পজিটিভ ৪০ রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে সেখানে ৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ ডেন-২ এর উপস্থিতি পেয়েছে। তবে, পরপর দুই বছর একই সেরোটাইপ বা ধরন প্রভাব বিস্তার করায় চলতি বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কম দেখছেন গবেষকরা। এর বাইরে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ ডেন-৩ শতাংশ, ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ রোগী ডেন-৪ আক্রান্ত। তবে, বিশ্লেষণে ডেন-১ আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহ বলেন, এখন অধিকাংশ রোগী শক সিনড্রোমের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। রক্তক্ষরণ ও শরীরে পানি শূন্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়ছেন। অনেক রোগী স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছেন না। কারও কারও পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসছে। এসব রোগীর ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা জরুরি। তবে, অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ আছে। এর মধ্যে এবার ডেন-২ তে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অনেক রোগী একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। গত বছরও শক সিনড্রোমে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ডা. মো. সাইফুল্লাহ বলেন, এখন ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে আমরা দুটি বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। শক সিনড্রোম ও ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল হওয়ার আগেই হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ এ বিশেষজ্ঞের।
এদিকে, রোববার সারা দেশে ৬৯৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৮ হাজার ৬৪৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৪২ হাজার ৪৭০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২১৪ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। মারা যান এক হাজার ৭০৫ জন। এদিকে, রোববার ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া চারজনের মধ্যে ঢাকা মহানগরে ছিলেন তিনজন। অপরজন ময়মনসিংহ বিভাগের। অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তদের ৬০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ নারী।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস