অনলাইন ডেস্ক : দুই, পাঁচ বছর নয়; দীর্ঘ ১৮ বছরেও বগুড়ার সান্তাহার ২০ শয্যা হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ (ইনডোর) হয়নি সচল। কেন চালু করা যায়নি, সেটারও আছে নানা কারণ। তবে ‘কাগজে-কলমে’ হাসপাতালটির বহির্বিভাগ (আউটডোর) চলছে। ছুটির দিন ছাড়া চিকিৎসক ‘নিয়মিত দেখেন রোগী’, ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সহকারীরা ওষুধও নাকি রোগীকে বুঝিয়ে দেন!
তবে বহির্বিভাগ চালু থাকার বিষয়টি যাচাই করতে গত বুধবার সেখানে গেলে বেরিয়ে আসে পিলে চমকানো সব তথ্য। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ১০টার ঘরে থাকলেও হাসপাতালটির গেটে ঝুলছে বিশাল তালা। লোহার গেটের নিচে ও ওপর দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়েও মিলল না কারও সাড়া। অথচ ওই সময় বহির্বিভাগের কার্যক্রম চালু থাকার কথা। আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ফাহমিদা হরকিলের দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও এলাকার মানুষ তাঁকে কখনও দেখেননি। পাঁচজন সিনিয়র স্টাফ নার্স, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন ওয়ার্ডবয় সেখানে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। ফার্মাসিস্ট আবুল বাসার মাঝেমধ্যে নিজের সুবিধামতো রোগী দেখে ওষুধ দেন। তবে বুধবার তাঁকেও পাওয়া যায়নি। আরএমও ডা. ফাহমিদা হরকিলের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
সান্তাহারের বাসিন্দা আমিনুল হক বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সসহ ৯ জন স্টাফের কথা বলে বেতন-ভাতা তোলা হলেও কখনোই ডাক্তার আসেন না। দু-একজন রোগী এলেও চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান। ব্যবসায়ী হাকিম মণ্ডল বলেন, এই এলাকায় কোনো ক্লিনিকে এমবিবিএস চিকিৎসক রোগী দেখেন না। সরকারি হাসপাতালও নেই। এই কারণে এলাকার রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সান্তাহার পৌর এলাকাসহ আশপাশের লাখো মানুষের জন্য শহরে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল নেই। অসুস্থ হলে এই এলাকার মানুষকে ৫ কিলোমিটার দূরে নওগাঁ সদর হাসপাতাল কিংবা ৮ কিলোমিটার দূরে আদমদীঘি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। এই বিবেচনাতেই রথবাড়ি এলাকার ২০ শয্যা হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। কাগজে-কলমে এই হাসপাতালে ২৪ জন জনবলের মধ্যে ৯ জন নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছেন। তবে তারা সংযুক্তিতে অন্যত্র কাজ করেন।
জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে শাহরিন ইসলাম তুহিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। তবে নির্মাণকাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে কাজ বন্ধ করে দেন। এর পর দীর্ঘদিন কর্তৃপক্ষ নজর না দেওয়ায় হাসপাতালটি পরিত্যক্ত অবস্থায় মাদকসেবীর আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ২০১৯ সালে মন্ত্রণালয় ফের ৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকায় হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারসহ বাকি অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজ শেষ হয় ২০২১ সালে। এর পর ৩ বছর পার হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাগজে-কলমে ৯ জনবল নিয়োগ দেওয়া হলেও সেখানে চিকিৎসক-নার্স কেউই দায়িত্ব পালন করেন না। মাঝেমধ্যে গেট খুলে বসে থাকেন ফার্মাসিস্ট আবুল বাশার। কেউ চাইলে তিনি ২-১টি করে ওষুধ লিখে দেন। সান্তাহারে ৯ জন কাগজে-কলমে কর্মরত থাকলেও তাদের আদমদীঘি উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এই হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ চিকিৎসাসেবা চালু করতে হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-নার্সসহ মঞ্জুর করা জনবল, অস্ত্রোপচার, এক্স-রে যন্ত্র, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি পরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রোগীর বিছানাপত্র, অন্যান্য আসবাব ও অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে চাহিদাপত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ফার্মাসিস্টের ব্যবস্থাপত্রই ভরসা
২০০২ সালে নন্দীগ্রামে ২০ শয্যা হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শেষে উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ সালে। এর পর যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও ১৮ বছর ধরে চালু হয়নি এই হাসপাতাল। হাসপাতাল নির্মাণে সে সময় মোট খরচ হয় ৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৮ টাকা। ২০০৮ সালে হাসপাতালের জন্য ২৪টি পদ সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে এখানে কাগজে-কলমে একজন আরএমও, একজন মেডিকেল কনসালট্যান্ট, একজন মেডিকেল কর্মকর্তা, পাঁচজন সিনিয়র স্টাফ নার্স, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছেন।
নন্দীগ্রাম হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক আর নিচতলার কয়েকটি কক্ষ খোলা। ভূতুড়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় দেখা যায়, হাসপাতালে কোনো বিছানা ও আসবাব নেই। নেই বৈদ্যুতিক বাতি। ভবনের দরজা-জানালায় ঘুণ ধরে ভেঙে পড়ার উপক্রম। অনেক দরজা-জানালার কপাট খুলে পড়ছে। মেঝেতে ধুলা ও দেয়ালে শ্যাওলা বাসা বেঁধেছে। অপারেশন থিয়েটারে পড়ে আছে ভাঙা যন্ত্রপাতি। পাশেই জড়ো করে রাখা ময়লার স্তূপ।
ফার্মাসিস্ট সোহেল হায়দার জানান, তিনি সরবরাহ অনুসারে কিছু ওষুধ রোগীদের ফ্রিতে সরবরাহ করেন। কোন রোগের কোন ওষুধ তা তিনি মুখস্থ করে ফেলেছেন। চিকিৎসক ফারজানা পারভিন বলেন, আমি নিয়মিত বহির্বিভাগে রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র দিই। সেখানে ভর্তি কিংবা অপারেশন করার পরিস্থিতিতে কোনো রোগী এলে সুযোগ না থাকায় তাদের জেলা সদরে যাওয়ার পরামর্শ দিই। হাসপাতালটির দায়িত্বপ্রাপ্ত আরএমও ডা. একেএম সাহিনুর হাসানের মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
আরএমও থাকেন ২০ কিলোমিটার দূরে
শিবগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের উন্নত চিকিৎসার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয় ২০ শয্যার আলিয়ারহাট হাসপাতাল। প্রথমে আধুনিক অপারেশন থিয়েটারসহ চিকিৎসাসেবার অনেক যন্ত্রপাতিই স্থাপন করা হয় হাসপাতালটিতে। কিন্তু সেবা চালু করা হয়নি। তবে সেখানে রোগী ভর্তি শুরু না হলেও চিকিৎসকসহ ১১ জন কর্মী আছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও লোকবল নিয়োগের অনুমতি না পাওয়ায় চালু করা যাচ্ছে না হাসপাতালটি।
দাবি করা হচ্ছে, সেখানে বহির্বিভাগে একজন উপসহকারী মেডিকেল অফিসার রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেন। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বরাদ্দ সাপেক্ষে ওষুধও সরবরাহ করা হয়। এলাকার বাসিন্দা আমীর হামজা বলেন, বর্তমানে এখানে সাধারণ রোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসার যন্ত্রপাতি শিবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থানান্তর করা হয়েছে। আলিয়ারহাট হাসপাতালের আরএমও ডা. সুতনু রায় থাকেন ২০ কিলোমিটার দূরে মোকামতলায়। তিনি বলেন, শুরুতে সেখানে কিছু লোকবল নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ওষুধ বরাদ্দ ও পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় হাসপাতালটি চালু করা যায়নি। পরে নিয়োগ করা চিকিৎসকদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে হাসপাতালটি চালুর ব্যাপারে দাপ্তরিক কাজ চলছে।
বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম জানান, ২০ শয্যার তিনটি হাসপাতালের বহির্বিভাগ পুরোদমে চালু রয়েছে। সেখানে ছুটির দিন ছাড়া সব দিনই সেবা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ আন্তঃবিভাগ চালু করতে জনবল ও অন্য বরাদ্দের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে সেখানে কর্মরত অনেকে সংযুক্তি নিয়ে অন্য হাসপাতালে কাজ করছেন।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস