অনলাইন ডেস্ক : এক রাতের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যায় জেলার ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর আমন ফসল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দূর্গাপুর উপজেলায়। এ উপজেলায় ৭ হাজার হেক্টর জমির আমন ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। তারমধ্যে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির আমন ফসল। এছাড়া কলমাকান্দায় ৮ হাজার ৩৪৫ হেক্টর, বারহাট্টায় ৫ হাজার ১১৭ হেক্টর, পূর্বধলায় ২ হাজার ১০০ হেক্টর ও সদরে ১ হাজার ১৮০ হেক্টর আমন ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া বন্যার পানিতে বিছিন্নভাবে শাক সবজির বাগান নষ্ট হয়েছে। যার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধারণা করা হচ্ছে ৩১৩ কোটি টাকা। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৭৫ হাজার ৬৮০ জন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমির আমান ফসল পানিতে নিমজ্জিত হলেও, সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৫১২ হেক্টর জমির আমন ফসল। অনেক প্রান্তিক কৃষক ধারদেনা করে আবাদ করলেও ঢলের পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে তাদের মাঠের ফসল। মাঠের এ ফসল হারিয়ে এখন দিশেহারা তারা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় দৃশ্যমান হয়েছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় বেশিরভাগ এলাকায় আমন ফসল সম্পূর্ণ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো পানির নিচে আছে অনেক ফসলি জমি। যেসব জমির আমন ফসল জেগে উঠেছে তাতে ফলন হবার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
কলমাকান্দা উপজেলার চৈতা ইউনিয়নের চৈতা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, আমার মোট ১৪ কাটা ক্ষেতের সবটাই পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানি কয়েক দিন স্থায়ী হওয়ার পর যখন পানি কমল, তখন দেখলাম আমার ক্ষেতের একটি ধান গাছও অবশিষ্ট নাই। সব পানিতে তলিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এখন নতুন করে আর ধান রোপন করার সুযোগ নেই, আমার যা ছিল সব শেষ। এখন পৌষ মাস পর্যন্ত আমার এই জমি পতিত পড়ে থাকবে। এরপরে আবার বোরো ফসল করতে পারব, এছাড়া এখন আর কিছু করার নাই।
রংছাতি ইউনিয়নের কৃষক মো. হেলাল মিয়া বলেন, পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় আমার যে ১৬-১৭ কাঠা জমির ধান রোপণ করছিলাম, তার সবগুলাই একেবারে শেষ। যাও ছিল সেগুলো পানি ৪-৫ দিন স্থায়ী হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু করার নাই, আল্লাহর ওপর তো আর আমাদের কারো হাত নেই। এখন কাজকাম করে যে খামু তারও অবস্থা নেই। এলাকায় তেমন কোনো কাজ নেই, এখন কি করে সংসার চালাব তা নিয়ে শুধু চিন্তা করি। পানিতে ভেসে গেছে সাথী আক্তারের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম তার পোল্ট্রি মুরগির খামার। রাতের অন্ধকারে বন্যার পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন। আক্ষেপ করে সাথী বলেন, আমরা ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমাদের মুরগির ঘরে কোমর পানি। সেখানে ৬০০ মুরগির বাচ্চা ছিল, একটাও বাঁচাতে পারিনি। পাশাপাশি মাঠে যে ধানের জমি ছিল সেগুলোও চলে গেছে পানির নিচে। সব মিলিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় আছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি জনিত কারণে নেত্রকোণা জেলায় আবাদকৃত ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর রোপা আমনের মধ্যে ২৪ হাজার ৬৬৭ জমি নিমজ্জিত হয়েছিল। অপরদিকে আবাদকৃত ১ হাজার ৪৬৫ হেক্টর শাকসবজির জমির মধ্যে ১৭৭ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। আমরা মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করি। আমাদের এ জেলায় ৭৫ হাজার ৬৮০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। টাকার সংখ্যায় এর পরিমাণ ৩১৩ কোটি টাকা।
এখানে যে বন্যা হয়েছে এটি রোপা আমনের জন্য একটি অসময়ের বন্যা। আমাদের ধানের যে স্তর ছিল, বেশিরভাগই ছিল ধানের থোর এবং ফুল অবস্থায়। যে কারণে আমাদের ধানের জমিগুলো বেশিরভাগই সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সবজির বিষয়টি অতিবৃষ্টি জনিত কারণে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা এই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদেরকে, আগাম রবি ফসল যেগুলো আছে সেগুলো চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। বিশেষ করে সরিষা আবাদের পরামর্শ দিচ্ছি। যেহেতু জমিটা ফাঁকা থাকবে সেহেতু এই সময়ে তারা সরিষা আবাদ করে ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে কৃষি পুনর্বাসন প্রস্তাবনা সরকারের কাছে প্রেরণ করেছি। আমরা আশা করছি সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন অথবা প্রণোদনা, যেভাবেই হোক সহযোগিতা এলে আমরা কৃষকদের মাঝে বিতরণ করব।
এছাড়া জেলায় কমপক্ষে ১ হাজার ৭৩০টি চাষের পুকুর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে করে জেলায় মৎস্যখাতে ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। জেলা মৎস্য অধিদপ্তর কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাজাহান কবীর বলেন, নেত্রকোণায় যে সাম্প্রতিক সময়ে অতি বৃষ্টি ও উজানের ঢলে যে বন্যা হয়েছে, তাতে প্রায় ১৭৩০ পুকুর তলিয়ে গিয়েছে। এখানে আমরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করেছি সেটা প্রায় আট কোটি টাকার মতো। এই ক্ষতি যেন পুষিয়ে নেওয়া যায়, আমাদের চাষিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য আমরা তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়েছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যদি কোনো নির্দেশনা পাই, পরবর্তীতে তাদের যে প্রণোদনার বিষয়টা আছে সেটা আমরা বাস্তবায়ন করব।
সংবাদদাতা/ ইলিয়াস