বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। দেশের কোনো কোনো জায়গা শুধুই দর্শনীয় স্থান নয়, যেন পৃথিবীর বুকে একখণ্ড স্বর্গ। সেসব স্থানের একটি হলো ‘সুসং দুর্গাপুর’।
যেখানে অবস্থিত সুসং দুর্গাপুর : মেঘালয়ের কোলঘেঁষে ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তরে নেত্রকোনায় অবস্থিত এক টুকরো স্বর্গ ‘সুসং দুর্গাপুর’। শান্ত, স্নিগ্ধ ও চারপাশে সবুজে আবৃত মনোরম পরিবেশ। তা ছাড়া রয়েছে পাহাড়, হ্রদ, টিলা, বিভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া ও নদ-নদীর সমাহার। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অন্যতম আদর্শ স্থান।
সাদামাটির পাহাড় : চারদিকে সবুজ গাছগাছালি আর তারই মাঝে একটি ‘সাদামাটির পাহাড়’। একটি দুটি নয়, শতাধিক সাদামাটির টিলা আছে সেখানে। চীনামাটিকে সাদামাটি বলে আখ্যায়িত করলেও চীনামাটি পুরোপুরি সাদা নয়। বরং কোথাও লালচে, ধূসর, হালকা নীলাভ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, হলুদ কিংবা টিয়া রঙেরও। বিচিত্র রঙের মাটির সংমিশ্রণ দেখা যায় পাহাড়গুলোয়। এর নিচেই রয়েছে আবার স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ। আর বিস্তৃত মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ। পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন করার ফলে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। চীনামাটির পাহাড়ের কাছেই রয়েছে কমলার বাগান, বিজিবি ক্যাম্প ও নয়নাভিরাম আরও দর্শনীয় স্থান। বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়ের রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অতুলনীয় গুরুত্ব। এটি টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ের অন্তর্ভুক্ত। এখানকার মাটি মিহি, ট্যালকম পাউডারের মতো, যা সিরামিক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল।
বিজয়পুর : বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের অন্যতম খনিজ অঞ্চল বিজয়পুর। পুরো এলাকা ঘিরে ছোট-বড়ো টিলা বা পাহাড় ও সমতল ভূমি মিলিয়ে দৈর্ঘ্যে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৬০০ মিটার খনিজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তিন নদী : সুসং দুর্গাপুরের অন্যতম আকর্ষণ হলো তিনটি নদী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন কাড়বে সোমেশ্বরী নদী। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর ও ভবানীপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সোমেশ্বরী নদীতে ঘুরে গেলেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঘেঁষে সবুজঘেরা ও লাল চীনামাটির অসংখ্য পাহাড়। বছরের বেশিরভাগ সময় এর একপাশজুড়ে থাকে ধুধু বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল। নদীর খরস্রোতা বয়ে চলার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সোমেশ্বরী নদী কয়লা, নুড়ি-পাথর ও সিলিকা বালু বয়ে আনে। কংস নদ ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগের তুরার কাছে গারো পাহাড়ে এই নদীর উৎপত্তি। সুসং দুর্গাপুর বাজারের উত্তরদিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে আত্রাখালী নদী। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
জমিদার বাড়ি : একসময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। ৩ হাজার ৩৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে ৯শ গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল এটি। বর্তমানে এটি নেত্রকোণার একটি উপজেলা। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে তার পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর শাসন করেন এ রাজ্য।
আরও যা আছে দেখার : তা ছাড়া বৈচিত্র্যয় জনবসতি, ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ছুটে চলা ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর কিছু প্রতিষ্ঠান, সাধু জোসেফের ধর্মপল্লী, রানীখং মিশন, ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, ফান্দা ভ্যালি, টঙ্ক শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ, কমরেড মণি সিংহের বাড়ি, মণি সিংহ জাদুঘর, সুসং মহারাজার সুদৃশ্য বাড়ি, রাশমণি স্মৃতিসৌধ, কমলা রানীর দীঘি, কংস নদ, আত্রাখালী নদী, চণ্ডীগড় গ্রামের মানবকল্যাণকামী অনাথালয়, কুল্লাগড়ার রামকৃষ্ণ মঠ, দশভুজা মন্দির, বিজয়পুরের স্থলশুল্ক বন্দর, বিরিশিরি বধ্যভূমিসহ আরও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণপিপাসুদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
কীভাবে যাবেন : ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি নেত্রকোনার দুর্গাপুর বাস ছেড়ে যায়। ৩০০-৪০০ ভাড়া নিবে। দুর্গাপুর বলা হলে এগুলো যাবে সুখীনগর। সেখান থেকে নৌকায় একটি ছোট নদী পার হয়ে মোটরসাইকেল, বাস বা রিকশায় দুর্গাপুর যেতে হবে। এ ছাড়া ট্রেনে নেত্রকোনা নেমে চল্লিশা বাজার থেকে মোটরসাইকেল কিংবা রিকশায় যেতে পারবেন দুর্গাপুর। রাতে থাকার জন্য জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ও আবাসিক হোটেল আছে।