বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, নজরুল মানে শুধুই বিদ্রোহ, শুধুই ঝড়ের তাণ্ডব। কিন্তু নজরুলের জীবনেও ছিল হাস্যরস। ছিল আনন্দময় অনেক দিক। নজরুল বেদনা লুকিয়ে হাসতেন। অন্যদেরও হাসাতেন।
কাজী নজরুল ইসলাম দারুণ রসিক মানুষ ছিলেন। তার হাসি নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। দূর থেকে শোনা যেত তার বিখ্যাত অট্টহাসি। একবার নজরুলকে খুঁজছেন তার বন্ধুরা। এবাড়ি ওবাড়ি খোঁজা হচ্ছে। হঠাৎ দূর কোনো বাড়ি থেকে অট্টহাসির শব্দ কানে এলো, খোঁজ মিলল নজরুলের। এমনই ছিল তার হাসির সুনাম।
১. সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামকে ডাকতেন দাদু বলে। কবি প্রায়ই সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। সে আসরে সাহিত্য অনুরাগী অনেকেই থাকতেন। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। সাহিত্য অনুরাগীদের সঙ্গে মিশে কয়েকজন গোয়েন্দাও আসতেন। একদিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর নজরুল কবিতা আওড়ালেন, তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।
কবিতার ধরন শুনে লোকটি মুখ লাল করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?
গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে। নজরুলের উত্তর।
২. প্রকৃত পক্ষেই তিনি ছিলেন রসিক। প্রতিপক্ষকে তিনি জবাব দিয়েছেন হাসির গান অথবা ব্যঙ্গ ছড়া লিখে। কবি গোলাম মোস্তফা যখন নজরুল সম্পর্কে লিখেছিলেন :
‘কবি নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গিছলাম
ভায়া লাফ দেয় তিনহাত
হেসে গান গায় দিন রাত…।’
উত্তরে নজরুল লিখলেন :
‘গোলাম মোস্তফা
দিলাম ইস্তফা।’
৩. একবার কবি নজরুল ইসলাম গেছেন সিরাজগঞ্জে, আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাওয়াদাওয়ার পর সবাইকে দই দেওয়া হলো। কিন্তু সে দই বেজায় টক হয়ে গিয়েছিল। তা খেয়ে নজরুল আসাদউদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে
চোখে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, তুমি কি এই দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?
৪. নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করেন। একদিন তিনি ওখানে দোতলায় বসে আছেন। এমন সময় এক কমর্চারী এসে বললেন, ‘কাজীদা, ইন্দুদি (সংগীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।’
এ কথা শুনে কবি সকৌতুকে বললেন, ‘আর কত নিচে নামব, ভাই?’
৫. কবি নজরুল ইসলামের এক বন্ধু ছিল, নাম শৈলেন। কবি প্রতিদিন তার কাছ থেকে চা খাওয়ার জন্য নিত্যনতুন ফন্দি আঁটতেন। একদিন আর কোনো ফন্দি-ফিকির না পেয়ে তিনি শৈলেনের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসাব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।
শৈলেন তো অবাক! এ আবার কেমন কথা! অনেক টাকা পাওয়ার সঙ্গে দুই কাপ চায়ের কী সম্পর্ক? তিনি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, দু পেয়ালা কেন?
কবি বললেন, আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেলে টাকা হয় না। লাখ পেয়ালা হতে আমার এখনও দু পেয়ালা বাকি।
৬. পান আর গান-নজরুলের কাছে এ যেন একে অপরের পরিপূরক। একদিন আসরে বসে গানের ফাঁকে চা-মুড়ি পর্ব সেরে তিনি পান মুখে দিতে যাবেন, এমন সময় একটি ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে এসে বলল, ‘তুমি এত পান খাও কেন?’
নজরুল তার কথায় হো হো করে হেসে উঠলেন। মিষ্টি করে বললেন, ‘গান গাই যে!’
৭. বারান্দায় বসে একদিন নজরুল দেখলেন একটা পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে একটি মেয়ে। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে মেয়েটি পেয়ারা চাইছে। কিন্তু গাছের ওপর যে, সে পেয়ারা দিচ্ছে না। নজরুল ভাবলেন, মেয়েটির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। যদি দেয় তো ভালো, না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সামনে গিয়ে কবি গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। কবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’ জবাবে মেয়েটি বলল, ‘কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।’ কাঠবেড়ালীর সঙ্গে ছোট মেয়েটির এই ঘটনা নজরুলকে এতটাই নাড়া দিল যে, তিনি লিখলেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের কবিতাটি।
‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী!
পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও?
বাতাবি লেবু? লাউ?…’