তৌহিদুর রহমান: জীবনের প্রথম ফেসবুক পোস্টটি লেখার মাঝপথে হঠাৎ মনের মধ্যে কী যেন একটা খোঁচা দিয়ে ওঠে। এই যে আমি আজ সাংবাদিক লায়েকুজ্জামানকে নিয়ে এতো গুণগান গাইছি, তিনি কি শুনতে পাচ্ছেন? জানতে পারছেন? তিনি তো আজ পৃথিবীতে নাই! যখন ছিলেন তখন কেন বলিনি এসব? লিখিনি কিছুই? সমস্যটা কোথায় ছিল আমার? হাতে তো অঢেল সময় ছিল! লেখারও উপায় ছিল। তাহলে ছিল না-টা কী? যেটা আমাকে একটিবারের মতোও মনে করিয়ে দেয়নি যে, ‘ওরে তৌহিদ, তোমার বহুদিনের সুহৃদ-সহকর্মী লায়েকুজ্জামান একজন ভালো সাংবাদিক ছিলেন; তোমার অনেক ভালোবাসা ছিল, সমীহ ছিল তাঁর প্রতি; সেই কথাগুলো তুমি এখন বলতে পারো, লিখতে পারো। লোকটা কতো সুখী হবেন জেনে!’
ল্যাপটপটা স্লিপ মুডে রেখে, দুই হাতের তালুতে মাথাটা গুঁজে দিয়ে, দুই চোখ বুজে অনেকক্ষণ ভাবলাম। তারপর আবার লিখতে বসে লেখাটার শেষ দিকে ঘোষণাটা দিয়েই দিলাম- ‘জগতের কাউকে নিয়ে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ যতো কথা বলার আছে, সব তাঁর জীবদ্দশাতেই বলে যাবো…।’
বিরতির ওই সময়টুকুতে আমার ভাবনার নিউরনে বিদ্যুৎ-চাবুকের মতো আঘাত করে করে কে যেন জানিয়ে দিলো লায়েকুজ্জামান ভাইয়ের মতো সকল সাংবাদিকের জীবদ্দশায় আমাদের মুখ বুজে থাকা আর মরার পরে মুখে প্রশংসার খই ফোটোনোর নেপথ্যের কার্যকারণ। সেটা আর কিছুই নয়- সংস্কার আর সংস্কৃতি। বেঁচে থাকা সাংবাদিক বন্ধু-সুহৃদ-সহকর্মীদের ভালো কাজ নিয়ে ভালো করে কিছু বলা বা লেখার সংস্কৃতি আমাদের নাই। আমাদের সংস্কারে আছে, এসব বলার-লেখার সময় আসে কেবল মারা যাবার পরে। বেঁচে থাকতে বড়জোর মিটিং-সিটিং-আলোচনা-গোলটেবিল অথবা নিদেনপক্ষে বড় কোনো পদক-পুরস্কার পেয়ে গেলে দু-চারটে কথা বলা যেতে পারে। বেঁচে থাকতে সাংবাদিককে নিয়ে আবার এতো কথা কিসের?
এখন সময় এসেছে এই সংস্কার-সংস্কৃতির শৃঙ্খল ভাঙার। অর্ধশতাব্দীরও বেশি বয়সী আমাদের এই বাংলাদেশের প্রামাণ্য ইতিহাসের পাতা একটার পর একটা উল্টে দেখে কেউ বলুক তো, দেশের কোন শ্রেণী-পেশার কেউ সত্যিকারের দেশপ্রেম-জনপ্রেম দেখিয়ে দেশ-জাতির জন্য একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের চেয়ে বেশি সাহসিকতা দেখিয়ে চলে জীবনভর! আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে রাখলাম।
কিন্তু ট্র্যাজিডি দেখেন! অফিসে নবীন কোনো সাংবাদিক এসে ঢুকলেই সিনিয়ররা তাকে অনেক জ্ঞানের সাথে একটা জ্ঞানগম্ভীর বয়ান শুনিয়ে রাখেন। সেটা হলো- ‘শোনো বাছা, সবশেষে সবসময়ের জন্য মনে রাখবা-ে এটা কিন্তু থ্যাংকলেস জব।’ মিডিয়া হাউজে এই ‘দর্শন’ কবে কীভাবে চালু হয়েছে, আমার জানা নাই। তবে দীর্ঘ ২৯ বছরের অফিসজীবনে অনেক কিছুই জানা হয়েছে, বোঝা হয়েছে আমার। আমি বুঝতে পেরেছি, অনেক ‘বিধ্বংসী দর্শন’, ‘সংকীর্ণ সংস্কৃতি’ চালু আছে মিডিয়া হাউজগুলোতে। অফিসজীবনের অবসান ঘটিয়ে অনেক দূরে চলে এসে আমি আজ তাই স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে সবার জন্য দাবি জানাই- ‘মরণোত্তর নয়, জীবদ্দশায় চাই’।
তবে আমি প্রকৃতিবিজ্ঞানের মাঝে ডুবে থাকা মানুষ। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’র মর্ম আমি জানি ও মানি। জগতের সবকিছুরই এদিক-ওদিক আছে; মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ থাকে। মানুষের সমাজজীবনাচারেও তাই। একই বিষয়ের ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা দুটোই কম-বেশি থাকে। একদিকে যেটা একরকম; অন্যদিকে সেটা আরেকরকম। তাই যেকোনো বিষয়ের দুটো দিকই বুঝে নেওয়া আমার পছন্দ। নইলে ভুল হয়ে যেতে পারে। প্রতি বৃহস্পতিবার ‘সাংবাদিকের আরশিনগর’-এ আমি দেশের জীবিত এবং কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা সত্যিকারের সাংবাদিকতাটা কৃতিত্বের সাথে করে যাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে যে লেখালেখি শুরু করলাম, তারও নিশ্চয় দুটো দিকই থাকার কথা।
‘ভালো’ দিকগুলো আমি যা দেখতে পাই, তা হলো :
১. মরণোত্তর পদক-পুরস্কার-সম্মাননা নামের প্রহসনগুলো বন্ধ করাতে সহায়ক হবে। কোনো সাংবাদিককেই শুধু নয়, যেকোনো ক্ষেত্রের যেকোনো যোগ্য মানুষকে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য যার যা দেয়ার আছে, তা ওই ব্যক্তির জীবদ্দশাতেই, এমনকি কর্মরত থাকা অবস্থাতেই তাঁর হাতে তুলে দেয়ার মতো সুবিচার-সুবিবেচনা প্রতিষ্ঠিত হবে। কারো যদি অকস্মাৎ অকাল মৃত্যু ঘটে যায়, তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেই কাজটি করতে হবে; তাঁর পরিবার-পরিজন, স্বজন-আপনজনদের কারো হাতে পদক-পুরস্কার-সম্মানির মতো বস্তুগত প্রাপ্তিগুলো তুলে দিতে হবে। আর মরণোত্তর পর্বে শুধু স্মরণসভা, শ্রদ্ধাসভা, মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মবার্ষিকী পালন এবং তাঁর জীবনীগ্রন্থ, কর্ম-আদর্শ-দর্শন বেশি বেশি প্রচার-প্রসার চালিয়ে যেতে হবে। আমার এই সমস্ত প্রস্তাব-প্রচেষ্টা রাষ্ট্রীয়, সরকারি, বেসরকারি, নাগরিক সকল পর্যায়ের জন্য।
২. জীবিত সাংবাদিকের ভালো কাজের প্রচার-প্রশংসা তাঁকে আরো উজ্জীবিত করবে; আরো ভালো কাজের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ‘উসকায়িত’ করবে।
৩. কোনো ধরনের অশুভফাঁদের হাতছানি ওই সাংবাদিককে নিবৃত্ত করবে এবং বাকি জীবন তাঁকে শুভকাজ ও সুচিন্তাবলয়ে আটকে থাকতে বাধ্য করবে; বিপথগামী হতে ভেতর থেকে বাধা দেবে।
৪. অন্য সাংবাদিকরাও ভালো কাজে উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত হবেন।
৫. অযোগ্য-কমযোগ্য সহকর্মীদের ঈর্ষানল থেকে যোগ্য ও স্বীকৃত-পুরস্কৃত সাংবাদিকটিকে রক্ষাকবজের কাজ করবে।
৬. অযোগ্য-কমযোগ্যদের মাঝে যোগ্য সহকর্মীর প্রশংসা-স্বীকৃতির সুসংস্কৃতি গড়ে তুলবে।
৭. অযোগ্য-কমযোগ্যদের মাঝে আপন যোগ্যতা বাড়ানো, যাকে বলে আত্মোন্নয়ন, সেই অতি জরুরি কাজটার চর্চা, এমনকি প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যেতে পারে।
৮. এই সমস্ত শুভচর্চা ধীরে ধীরে কর্মীদেরকে শুদ্ধাচারে অভ্যস্থ করবে; অফিসের কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠবে; কাজ আনন্দময় ঠেকবে এবং একসময় কর্মীদের প্রোডাকটিভিটি, ক্রিয়েটিভিটি, ‘ইনোভেটিভিটি’ বেড়ে যাবে।
৯. আমার পোস্টের সাথে জুড়ে দেয়া সাংবাদিক বন্ধুটির দুর্দান্ত সব কাজের নমুনা অনেক পাঠক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নতুন করে দেখিয়ে-পড়িয়ে আরেকদফা নাড়া দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
১০. বলা যায় না, আমার এই কলামের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও ওই সাংবাদিক বন্ধুটির প্রতি সুনজরদারি তৈরি হবে; দ্রুতই হয়তো তাঁকে কোনো রাষ্ট্রীয় পদক-পুরস্কারে ভূষিত করার শুভপ্রস্তাব উঠে পড়বে।
আরো কোনো ভালো দিক থেকে থাকলে জানাবেন; আমি যোগ করে নেবো।
এবার মন্দ দিকগুলো যা পাই, তুলে ধরি :
১. প্রশংসিত সাংবাদিক বন্ধুটি বয়সে তরুণ, স্বভাবে বেসামাল হলে তাঁকে অহংকারী করে তুলতে পারে।
২. ‘এতো এতো প্রশংসা; আমার তাহলে হয়ে গেছে; আর এতো কষ্ট করার দরকার নাই’- এই জাতীয় পিছটানের ‘ভূতে’ পেয়ে তাঁর সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
৩. অনেকের মনেই খোঁচা দিয়ে কষ্ট জাগাতে পারে এই প্রশ্নটা যে, রিপোর্টার ভালো রিপোর্ট করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। এই নিয়ে এতো বড় বড় লেখার-বলার কী আছে!
৪. শুধু তাই না, ‘সাংবাদিকের আরশিনগর’ কলামটি বা এই ধরনের কোনো লেখা যদি এই মুহূর্তে কোনো একটা মিডিয়া হাউজকে বলেন প্রচার-প্রকাশ করতে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তাঁদের মুখ থেকে প্রথম যে প্রশ্নটি আপনা-আপনিই বের হবে, সেটা হলো- ‘উনি কি মারা গেছেন?’ যখন শুনবেন, না, উনি বেঁচে আছেন, তখন সেই হাউজকর্তা হাত-মন-মাথা গুটিয়ে, নাক-চোখ-ভুরু কুঁচকে বলবেন …। কী বলবেন, জানা কথা নয় কি? একেকজন একেকরকম ভাবে অপারগতার কথা জানাবেন। এটাই যে প্রচলিত ধারা। এটাই আমাদের চলমান সংস্কার-সংস্কৃতি।
৫. আরেকটা ‘মজার’ মন্দ দিক বলি। ভালো দিকগুলোর শেষ, মানে ১০ নম্বর পয়েন্টটা লেখার সময় আপনমনেই ঠোঁটের কোণে একটা বক্রহাসি এসে পড়েছিলো। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সুনজরের বদলে উল্টোটাও তো ঘটতে পারে! ভাবা হতে পারে- এই ব্যাটা সাংবাদিককে নজরদারিতে রাখতে হবে। ওর পিছে ‘ফেউ’ লাগিয়ে দিতে হবে। নইলে সে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে একদিন পাষাণমূর্তি বানিয়ে ছাড়বে।
বন্ধুরা, আরো কোনো মন্দ দিক থেকে থাকলে যোগ করে দেবেন, আশা করি।
সবশেষে আমার ‘বৃহস্পতি’তে ‘সাংবাদিকের আরশিনগর’ কলামের সম্ভাব্য ভালো-মন্দের পাল্লা মেপে সবার মূল্যবান সিদ্ধান্তটি জানাবেন- ‘আমি কি চালিয়ে যাবো ❓❓