Binoy Amin Binoy : বাহাদুর শাহ জাফর: স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো শেষ মুঘল সম্রাট

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহিরুদ্দীন বাবরের ১৯তম উত্তরসূরী শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর মৃত্যুর আগে সূদুর রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় বেদনার্ত হয়ে লিখলেন,

“কিৎনা বদনসিব হ্যাঁয় জাফর…দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে।”

“কী দুর্ভাগ্য জাফরের, স্বজনদের ভূমিতে তার দাফনের জন্য দু’গজ মাটি, তাও মিলল না”।

শত বছর পর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করে পরিদর্শক বইতে লিখলেন,

“হিন্দুস্তানে হয়তো তুমি দু’ গজ মাটি পাওনি। কিন্তু তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে”।

রাজীব গান্ধীর মন্তব্যে এক বিন্দুও অতিরঞ্জন ছিল না। মুঘলরা যেখান থেকে যেভাবেই আসুক, ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে মানুষের জেগে উঠার, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সাথে জড়িয়ে আছে বাহাদুর শাহ জাফরের ব্যক্তিগত হাহাকার ও বেদনার ইতিহাস।

জন্ম ও শৈশব

তার পুরো নাম ছিল আবুল মুজাফফার সিরাজুদ্দীন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ গাজী। উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি সমধিক পরিচিত বাহাদুর শাহ জাফর নামে। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ অধিপতি, যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার। পুনর্জাগরণের। মুক্তির স্বপ্নে বিভোর উপমহাদেশের আপামর মানুষ নেতা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন তাকে।

বাহাদুর শাহ জাফর ১৮তম মুঘল সম্রাট মইনুদ্দীন আকবর শাহের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি ইতিহাসে সম্রাট দ্বিতীয় আকবর নামে সমধিক পরিচিত। সম্রাট দ্বিতীয় আকবর ১৮০৬ সাল থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত সিংহাসনে আসীন ছিলেন। আর দ্বিতীয় আকবরের পিতা ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। তখন যদিও ব্রিটিশ আগ্রাসনে মুঘল সম্রাটদের সার্বভৌমত্ব দিল্লীর লাল কেল্লাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছিল।

বাহাদুর শাহ জাফরের জন্মও হয়েছিল লাল কেল্লায়। ১৭৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার মা ছিলেন সম্রাজ্ঞী লাল বাঈ। ব্যক্তিগতভাবে বাহাদুর শাহ জাফর একজন গুণী মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি একজন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার, আধ্যাত্মিক কবি ও ধর্মীয় সাধক হিসেবে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।

সিংহাসনে আরোহণ

বাহাদুর শাহ জাফর যখন সিংহাসনে আরোহন করেন, তখন তার বয়স ৬২ বছর। ১৮৩৭ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে বসেন তিনি। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের শোচনীয় অবস্থা। তার পিতামহের সময় থেকেই মুঘল সম্রাটরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী হয়ে পড়েছিল। মুঘল কর্তৃত্ব তখন লাল কেল্লার চার দেয়ালে বন্দী। প্রচণ্ড প্রতাপশালী মুঘল সাম্রাজ্য তখন ইংরেজদের পদানত। ইংরেজরা ধীরে ধীরে তাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করেই চলছিল। মুদ্রা থেকে সম্রাটের নাম বাদ দেওয়া, দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত করা সহ ধীরে ধীরে মুঘলদের নাম সমূলে উৎখাতে সচেষ্ট হলেও সম্রাট হওয়ার পর বাহাদুর শাহ জাফর জানতেন তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কিছুই করতে না পারার হতাশা আর হাহাকার ভুলে থাকতে তিনি কাব্যচর্চায় সময় কাটাতেন। তিনি ছিলেন একজন উচ্চমানের কবি। তার অনেক কবিতা এখনো উচ্চারিত হয় মুখে মুখে।

সিপাহী বিদ্রোহ

বাহাদুর শাহ জাফর হয়তো শেষ কয়েকজন মুঘল সম্রাটদের মতো ইতিহাসের পাতায় বেতনভোগী শাসক হিসেবেই হারিয়ে যেতেন। কিন্তু ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসায় ইতিহাসে তিনি জায়গা করে নিলেন অনন্য মর্যাদায়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষের মনে জায়গা করে নিলেন স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। যদিও এর জন্য তাকে ভোগ করতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ, নির্যাতন; হারাতে হয়েছে সন্তান, সম্পতি, রাজ্য- সবকিছু।

লাল-কেল্লার মধ্যে আবদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তার বয়স তখন প্রায় ৮২ বছর। পলাশীর যুদ্ধের পর কেটে গেছে ১০০ বছর। এই শত বছরে শুধুই শক্ত হয়েছে ইংরেজ শাসনের ভিত। ইংরেজদের অপশাসন, লুটপাট আর অত্যাচারে নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষের হাহাকার তখন চরমে। এমন সময় মুক্তির স্বপ্নে জেগে উঠল সিপাহী-জনতা। জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহী-জনতা লাল কেল্লায় এসে সম্রাটকে অনুরোধ করলেন, ইংরেজদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। বৃদ্ধ সম্রাট বয়সের কারণে প্রথমে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু, ভারতবর্ষে তখন তার চেয়ে সর্বজনবিদিত কিংবা গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাহীদের অনুরোধে অবশেষে রাজি হন তিনি।

বিদ্রোহীদের মধ্যে পড়ে যায় উৎসবের আমেজ। তারা বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। গভীর রাতে ২১ বার কামানের তোপধ্বনির মাধ্যমে বৃদ্ধ সম্রাটকে ভারতবর্ষের স্বাধীন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সিপাহীরা একত্র হয়ে স্লোগান দেন-

“খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম-ই-সিপাহি।” অর্থাৎ, “দুনিয়া আল্লাহর, রাজ্য বাদশার, হুকুম সিপাহীর।”

বিদ্রোহে বাহাদুর শাহ জাফরের ভূমিকা

বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার মাধ্যমেই সিপাহী বিদ্রোহ একটি রাজনৈতিক রূপ পায়। যার শুরুটা ছিল শুধু মাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তিনি সকল স্থানীয় শাসকদের চিঠি দিয়ে এ বিল্পবে অংশ নেওয়ার আহবান জানান। এ বিদ্রোহে তার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়ার বিষয় ছিল না। তিনি একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠন করার অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন, যারা শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করবে। বাহাদুর শাহ জাফর বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ সংবাদে উজ্জীবিত হয়ে লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বারেলি, ঝাঁসি, বাংলা অঞ্চল সহ সারা ভারতবর্ষে ওঠে বিদ্রোহের জোয়ার। এ যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের তিন পুত্র- মির্জা মুঘল, মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা আবু বকর।

আকস্মিক একতাবদ্ধ হওয়া নানা মতের ও নানা অঞ্চলের সিপাহীদের মধ্যে কোনো সৃশৃঙ্খল বন্ধন কিংবা ঐক্য ছিল না। যার কারণে তাকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হয়। সুযোগসন্ধানী অপরাধীরাও এ বিদ্রোহের সুযোগে বিশৃঙ্খলায় লিপ্ত হয়। সিপাহীদের মধ্যে যাতে ঐক্য বজায় থাকে, সেজন্য তিনি সজাগ ছিলেন। সিপাহীদের মধ্যে সামরিক দক্ষতা ও অর্থাভাব ছিল প্রকট। যা এ বিদ্রোহের সফলতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এ বিদ্রোহে তিনি সর্বতোভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সিপাহীদের খরচ মেটাতে তিনি তার সকল সম্পদ বিক্রয় করে দেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত আসবাব-তৈজসপত্রও তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে তার পুত্র মির্জা মুঘল সিপাহীদের জন্য কিছু অর্থ চেয়ে লিখেছিলেন, তখন জাফর অসহায় হয়ে বলেছিলেন,

“মির্জা মুঘলের কাছে আমার ঘোড়ার সাজ, রূপার হাওদা, কুর্সিগুলো পাঠাও, যাতে মির্জা ‍মুঘল সেগুলো বিক্রয় করে খরচ চালিয়ে নিতে পারে। আমার কাছে এছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।”

দিল্লীর পতন

দেশীয় রাজন্যবর্গের অসহযোগিতা, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, অর্থাভাব, সামরিক দক্ষতার অভাব সহ নানা কারণে খেই হারিয়ে ফেলে সিপাহী-জনতার বিল্পব। পাতিয়ালার রাজা কিংবা শিখদের মতো অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় ইংরেজদের পক্ষে। ইংরেজদের সমন্বিত আক্রমণের মুখে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই দিল্লীর পতন মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে যায়। সম্রাটের চারপাশেও ব্রিটিশদের চর কিংবা তাদের পদলেহী অনেকেই বিদ্যমান ছিল। তারা সম্রাটকে আত্মসমর্পণ করতে প্ররোচিত করতে থাকেন। সম্রাট তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকা পলায়নপর বিশৃঙ্খল বাহিনীর প্রতি তখন তার তেমন আস্থা ছিল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!