নজরুল ইসলাম : পূর্ববঙ্গে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব কমিউনিস্ট বিপ্লবী আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ খ্রিঃ ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার অন্তর্গত ধুবুলিয়া গ্রামে। পিতা আবদুল জলিল মাতা আমেনা বেগম। তাঁর শিক্ষাগ্রহণ শুরু পিতার কর্মস্থল দার্জিলিং শহরে একটি বাংলা মাধ্যম প্রাথমিক স্কুলে, শিশু শ্রেণীতে। তিনি এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পাশ করেন ১৯৪৩ সনে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে, ইন্টারমেডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করেন রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৪৫ সনে। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ পাশ কোর্সে ভর্তি হন, স্নাতক পর্ব শেষ করে ১৯৪৭ সনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে এম.এ. প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন। একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদেও ভর্তি হন।
১৯৪৮ সনের ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ভাষণে বলেন : ‘উর্দু কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। হলভর্তি ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র আবদুল মতিন ও তার কয়েকজন সহযাত্রী ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানান। তার প্রতিবাদী চরিত্র এভাবেই প্রথম প্রকাশ পায়। এরপর ১৯৪৯ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে আব্দুল মতিন গ্রেফতার হন এবং ২ মাস জেলে কাটান।
১৯৫০ সনের ১১ মার্চ আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দিবস (১৯৪৮) পালনের ছাত্র সভায় ১১ সদস্যের যে আন্দোলন পরিচালনা কমিটি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি) গঠিত হয় তার আহবায়ক মনোনীত হন আব্দুল মতিন। আর এখান থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন সংগঠিত করতে আব্দুল মতিনের সার্বক্ষণিক পথচলা শুরু। কখনও পতাকা দিবস পালন, কখনও প্রতিবাদী সভার আয়োজন, কখনও চাঁদা তোলার মত বহুমাত্রিক কাজের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তার পরিচিতি গড়ে উঠে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ নেতা-কর্মী হিসেবে। ১৯৫১ এর এপ্রিলে তিনি একক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের নিকট স্মারকলিপি পাঠান। এর অনুলিপি পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক মহলে। এভাবেই ছাত্র আব্দুল মতিনের ‘রাষ্ট্রভাষা মতিন’ পরিচিতির প্রারম্ভিক প্রকাশ।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে’। ঘোষণার পরদিন থেকে শুরু হয় ছাত্রসমাজের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে বিশেষ ভূমিকা রাখেন আব্দুল মতিন ও সহযোগী ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দ। ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য আব্দুল মতিন। ৪ঠা জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের যে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় তার অন্যতম ঘটক আব্দুল মতিন।
আন্দোলন বানচাল করতে প্রশাসন ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১ মাসের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ধারা জারী করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় রাজনীতিবিদ ও তাদের সমর্থক ছাত্র নেতৃত্ব ১৪৪ধারা ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রতিবাদ জানান আব্দুল মতিন ও তার ২ সহযোগী ছাত্রযুব নেতা। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে আব্দুল মতিনের বক্তব্যের পক্ষে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীগণ একাট্টা সমর্থন জানালে শুরু হয়ে যায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রতিবাদী প্রক্রিয়া। টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ কোন কাজে আসে না।
পরিণামে মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণ, আশপাশে ও রাজপথে ছাত্র-জনতার জমায়েতে পুলিশের গুলিবর্ষণে রফিক-জব্বার-বরকত প্রমুখ শহীদ হন, অনেকে আহত হন। আব্দুল মতিন ও তার সহযোগী নেতৃবৃন্দ পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি যে গায়েবানা জানাজা ও শোকসভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন সেই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়ে যায় ছাত্র জনতার সরকার-বিরোধী গণআন্দোলন। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে শহরে-গ্রামে। আব্দুল মতিনের কর্মব্যস্ততা যেমন মিছিলে-জমায়েতে তেমনি ঢাকার বাইরে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও ইপিআর-এর গুলিতে শহীদ হন শফিউর-আওয়াল-ওহিউল্লাহ সহ আরো কয়েকজন। কারাগার ভরে ওঠে সংগ্রামী ছাত্রজনতার গ্রেফতারে।
সরকারের প্রচন্ড দমননীতি এবং ৯ মার্চ আব্দুল মতিনসহ অন্যদের গ্রেফতারের ফলে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের ইতি, যদিও ঢাকার বাইরে আন্দোলন আরো কিছুদিন সচল থাকে। ভাষাসংগ্রামীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রথম দিনটি (২১ ফেব্রুয়ারি) চিহ্নিত হয় ‘শহীদ দিবস’ হিসাবে।
কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন ভিন্ন এক আব্দুল মতিন যিনি মার্কসবাদী সমাজ বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। নবগঠিত ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে ছাত্ররাজনীতিপর্ব শেষ করে আব্দুল মতিন কৃষক আন্দোলন-ভিত্তিক বাম রাজনীতিতে মনোযোগী হন। কৃষক আন্দোলন হয়ে ওঠে তার ধ্যানজ্ঞান। লক্ষ্য শোষনহীন সমাজ ও জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠন যা সর্বজনীন স্বার্থ পূরণের অনুকূল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৬৩ সনে ঢাকার রায়পুরায় ও ১৯৬৬ সনে সিলেটের কুলাউড়ায় অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে ভাসানীর সহযোগী নেতা হিসাবে আব্দুল মতিনের বিশেষ ভুমিকা। ভাসানীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত কৃষক জনতার ‘লালটুপি’ সম্মেলনগুলোতে আব্দুল মতিনের অবদান অনন্য। এগুলোতে নারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে আব্দুল মতিনের স্ত্রী গুলবদন্নেছা মনিকারও ছিল সাহসী অনবদ্য ভূমিকা।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬৮ সনে বাম রাজনীতির বিভাজনের ফলে গঠিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রধান নেতা আব্দুল মতিন। ১৯৭১ এর জুলাই পর্যন্ত তিনি একই পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এরপর নকশালবাদী ধারায় পরিচালিত পার্টিতে ভিন্নমতের কারণে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পরিত্যাগ। রাজনীতির এ ধারায় আব্দুল মতিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মার্কসবাদী কৃষক নেতা।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুল মতিনের আদর্শিক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ ঘটে ‘কৃষক-শ্রমিক অস্ত্রধর/পূর্ববাংলা স্বাধীন কর’ এবং ‘জনগণতন্ত্র কায়েম কর’ ও অনুরূপ শ্লোগানে। আর একাত্তরে মতিন-আলাউদ্দিনের প্রচেষ্টায় দেশের অভ্যন্তরে পূর্বোক্ত আদর্শের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন, সে উদ্দেশ্যে তাদের নেতৃত্বে গণফৌজ গঠন এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মোকাবেলা। আব্দুল মতিনের চিন্তা ছিল যুদ্ধের কৌশল হিসাবে ছোট ছোট গেরিলা স্কোয়াড গঠনের মাধ্যমে শত্রুদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা। এভাবে ১৮০টি গ্রাম হয়ে ওঠে গণফৌজের চেষ্টায় মুক্ত এলাকা।
একাত্তরে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিকের আশা- আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত না হওয়ায় লক্ষ্য অর্জনে আব্দুল মতিনকে আবার লড়াইয়ে নামতে হয়। ১৯৭২ সালে আত্রাইয়ের যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ আবদুল মতিন গ্রেফতার হন। দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৭৭ সনে মুক্তি পান। কিন্তু রাজনীতি তাকে মুক্তি দেয়নি। কমিউনিস্ট লীগ, চাষী সমিতি ইত্যাদি একাধিক দলগঠনের মাধ্যমে আব্দুল মতিন তার আদর্শিক লড়াই চালিয়ে গেছেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ছিলেন। বিশদ বিবরণে না যেয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে আজীবন বিপ্লবী আব্দুল মতিন আমৃত্যু সংগ্রামীর ভূমিকা পালন করে গেছেন।
আব্দুল মতিন ১৯৮৪ সনে চীনা পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশীদের আমন্ত্রণে ২০০০ সনে আমেরিকা সফরে যান এবং সেখানে ৪ মাস অবস্থান করেন। ২০০২ সনে তিনি ইউরোপ সফরে যান সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের আমন্ত্রণে। একুশে পদকসহ অনেক সম্মাননা ও পদক পেয়েছেন আব্দুল মতিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভুষিত করেছে।
আব্দুল মতিন একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট হিসাবে সাদামাঠা জীবন কাটিয়ে গেছেন। তার যোগ্য সহযোদ্ধা, জীবনসঙ্গিনী গুলবদন্নেছা মনিকার লড়াই এবং ত্যাগও কোন অংশে কম নয়। সে হিসাবে তিনি কমরেড আব্দুল মতিনের যথার্থ সহধর্মিনী। তাদের দুই কন্যা মাতিয়া বানু শুকু ও মালিহা শোভন স্বচেষ্টায় জীবন ও পবিবার পরিচালনা করছে।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ও মস্তিষ্কে আকষ্মিক রক্তক্ষরণে অচেতন আব্দুল মতিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসকদের সবচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ৮ অক্টোবর ২০১৪ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ আব্দুল মতিন তার চক্ষু (কর্ণিয়া) ও দেহদান করে গেছেন জনকল্যাণে।
আমরা এই আদর্শনিষ্ঠ বিপ্লবী ও আজীবন সংগ্রামী, মার্কসবাদী রাজনীতিক আব্দুল মতিনের বর্ণিল কর্মময় স্মৃতির উদ্দেশে সম্মান, শ্রদ্ধা ও লাল সালাম জানাই। তার আদর্শ দীর্ঘজীবী হোক, স্বপ্ন সফল হোক। ভাষা সংগ্রামী কমরেড আব্দুল মতিন